মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

সোমবার, ৪ মে, ২০২০

অদ্রীশ বিশ্বাসের আত্মহত্যা

অদ্রীশ বিশ্বাসের আত্মহত্যা
উৎসর্গ : শামশের আনোয়ার
 
হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
যখন আকাশের ইস্পাতে গিঁট বাঁধছিলে
দেখে নিচ্ছিলে গিঁট শক্ত হলো কিনা
পায়ের শিরাগুলো তাদের কুয়োর দড়ি দিয়ে রক্ত তো পাঠাচ্ছিল
তোমার হৃৎপিণ্ডের দিকে, ভালভ খুলে এবং বন্ধ করে
ওই দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম শুনে তাড়া পড়ে গিয়েছিল
তোমার শরীর জুড়ে, অথচ তুমি বরফের তৈরি মাথায়
জানি না কবে কোন দিন কখন নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিলে
আকাশের হুক থেকে ঝুলে পড়ে, ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করে নেবে
শেষ প্রশ্বাসের সঙ্গে শেষ বীর্য ফোঁটা ঝরেও ঝরবে না
কিছুটা হদিশ কি পাইনিকো ? পেয়ে তো ছিলুম--
বলেও ছিলুম, এ কী করছো অদ্রীশ তুমি, উত্তর দিলে না
নারীও পুরুষের মতো জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরে, জানাই ছিল না
আমি তো জানোই, নারীদেরই জড়িয়ে ধরেছি চিরকাল
পুরুষকে জড়িয়ে ধরার কথা ভাবলেই বিরক্তি ধরে, বমি পায়
মনে হয় রাস্তাছাপ রাজনীতি শরীরে আশ্রয় নিতে এলো
এও বলেছিলে তুমি, চিরকাল মুক্তযৌনতার পক্ষে
রজনীশ-আশ্রমের যৌনতার খেলা সমর্থন করো, সম্পর্কের ব্যাগাটেলি
তোমার যৌনজীবনের কথা জানতে চাইলে তবে লজ্জা পেয়েছিলে কেন
ইউরোপে গিয়ে বিদেশিনী প্রেম করেছিলে কিনা, রোমান হলিডে,
জুলিয়েট, জাঁ দুভাল, তার কোনো উত্তর দাওনি তো
তোমাকে বুঝতে পারা ক্রমশ জটিলতর করে দিয়ে তুমি
ফেলে গেলে বুদ্ধদেব বসুর উপহার দেয়া মিমিকে ১৯৬৫ সালে
লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত সিটি লাইটস জার্নালের দ্বিতীয় খণ্ডটি
যাতে হাংরিদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের
বিদ্যায়তনিক ভূমিকাটিসহ, ফুটপাথ থেকে কেনার সময়ে
হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
তোমার কাছেই জানলুম, জীবনানন্দের মেয়ে মঞ্জুশ্রীর চাকরি গিয়েছিল
সাউথ পয়েন্ট থেকে, মধুসূদন সান্যালের সাথে প্রেমের কারণে
বলেছিলে তুমি, যে বিদ্রোহী সে তো সমাজবিহীন, তার কেউ নেই
তার অদ্রীশ আছে, মলয়ের প্রথম সাক্ষাৎকার তুমি নিয়েছিলে
যখন কেউই পাত্তা দিতে চায়নি আমাকে, আমার প্রবন্ধগ্রন্হের
ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলে, জানি না কখন কবে প্রৌঢ় হয়ে গেলে
সংবাদপত্রে পড়লুম, যখন আকাশের খুঁটি থেকে ঝুলছিলে, ঘরে ছিল
আলো, নাকি অন্ধকার ঘরে তুমি শ্লেষ হাসি ঠোঁটে নিয়ে
এনজয় করেছো প্রিয় একাকীত্ব ; তখনও কি নিজেকে নিজে নিঃশব্দে
বলছিলে : এই বাংলায় দুইটি জিনিস আর ফিরবে না কোনোদিন :
সুভাষচন্দ্র বসু আর সিপিএম । মার্কস বা লানিন নয়, স্তালিনও নয়
মাও বা ফিদেল কাস্ত্রো নয়, কেবল সিপিএম ক্যাডারিত হাড়গিলে লোকেদের
ঘেন্না করে গেছো, তুমি তো প্যারিস রোম ফ্লোরেন্স ভেনিস ব্রিটেনে গিয়েছিলে
তবু তারা রাস্তায় তোমাকে ফেলে রায়গঞ্জে থেঁতো করেছিল
যাদবপুরের চারতলা বাড়ি থেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে
ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল, অথচ তুমি তো নিজেই বিনয় মজুমদারকে
হাসপাতালে দেখাশোনার ভার নিয়েছিলে, বিনয় মজুমদারের বউ রাধা
আর ছেলে কেলোকে সোনাগাছি গিয়ে খুঁজে-খুঁজে ছবি তুলে এনেছিলে
অর্ঘ্য দত্তবক্সির বইয়ের মলাটেতে দেখেছি তাদের, সত্যি বলতে কি
কয় দিন কয় রাত ঝুলেছো নিজের ঘরে, তারপর পিস হেভেনের শীতাতপে নয়
কাটাপুকুর মর্গে তিন দিন পড়েছিলে, বুক চিরে ব্যবচ্ছেদ হয়েছিল ?
ডাক্তারেরা পেয়েছিল কিছু ? জমাট বেঁধে যাওয়া দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
জানি না । শুনিনিকো । দেহেতে পোশাক ছিল ? কোন পোশাক ?
লাশকাটা ঘরে ? চোখ আর বন্ধ করোনিকো, সম্ভবই ছিল না
সবুজ প্লাস্টিকে মোড়া, ফুল নেই, রজনীগন্ধার রিদ নেই
সাজুগুজু সুন্দরীরা এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নিকো তোমার মরদেহ ঘিরে
কেওড়াতলায় উল্টো বন্দুক করে প্রতিষ্ঠানের সেলামি পাওনি তা জানি
নন্দন চত্বরে প্রতিষ্ঠানের মোসাহেবদের মতো শোয়ানো হয়নি দেহ
তোমার প্রিয় সন্দীপন ঘুরতো তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পিছনে পিছনে
জিগ্যেস করোনি তাঁকে সিপিএম কেন তোমাকে টার্গেট করেছিল !
আশে পাশে আরও কয়েকজনের শব ছিল, ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
দাদা নকশাল বলে শ্রীরামপুরের বাড়িতে হামলা করেছিল, তোমার কথায়
সেই লোকগুলো যারা বাংলার রেনেসাঁকে ধ্বংস করে গড়িয়ার মোড়ে নেচেছিল
বটতলা ফিরিয়ে আনলে তুমি গবেষণা করে, ভিক্টোরিয় বিদেশিরা যাকে
অশ্লীল ছাপ দিয়ে আদিগঙ্গার পাঁকে ছুঁড়ে ফেলেছিল
আর কমলকুমারের রেডবুক, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাঙালি মহিলার
লেখা উপন্যাস ‘মনোত্তমা’ খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরির তাকে অযত্নে রাখা
তখন হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
যেমন প্রথমবার প্রেসিডেন্সির প্রথম বছরে ঝালমুড়ি খেতে খেতে
প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়ায়, ক্যানিঙের ট্রেনে, গঙ্গার খেয়া নিয়ে এপার-ওপার
মা ‘লীলাবতী’কে নিয়ে বই লিখে হয়তো ভেবেছিলে পৃথিবীতে কাজ সাঙ্গ হলো
জানবো কেমন করে বলো, এই তো সেদিন ১৯৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
জন্মেছিলে তুমি, মৃত্যুর দিনটাকে আকাশের খুূঁটিকে বলে চলে গেলে
কেবল এটুকু জানি ২০১৭ সালে ১৬ই জুন কেওড়াতলার শ্মশানে প্রাঙ্গনে
ডেডবডি ক্যারিয়ার সার্ভিস গাড়িতে গোপনে শুয়ে গন্তব্যে চলে গেলে
পাখিরা কোথায় গিয়ে মারা যায় জানতে চেয়েছেন অরুন্ধতী রায়
তিমিমাছ বুড়ো হয় মারা যায়, রুই ও কাৎলা বুড়ো হয়ে মারা যায়
মারা গেলে তাদের গল্পগুলো জলের তলায় চাপা পড়ে থাকে--
কতো কাজ বাকি রয়ে গেল, সেসব প্রজেক্টের কেউই কিচ্ছু জানে না
যাকিছু বহুদিন সযত্নে সংগ্রহ করেছিলে সবই ফালতু মনে হলো
যা জরুরি মনে হলো তা ওই এক ঝটকায় দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
বন্ধ করে, নিঃশব্দে অট্টহাসি হেসে, আত্মনিধন করে ফেলা…
ছবিতে থাকতে পারে: 1 জন, চশমা এবং ক্লোজআপ
 
 
 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন