মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

প্রেমের কবিতা

  ( এই কবিতাগুলো হাংরি আন্দোলনের কবিতা নয়। হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার বহু পরে এগুলো লখনউতে থাকতে লেখা )


দালাল
এ কী কুলনারী তুমি জাহাজঘাটায় দেহ বেচতে এসেছো
        লুঙিপরা পানখোর দালাল রাখোনি
সাদাপোশাকের কবি শরীর ঝাঁঝরা করে দেবে
শাঁখা-নোয়া খুলে তারা দু'হাত হিঁচড়ে টেনে তুলবে লরিতে
লকাপে ল্যাংটো মাঝরাত---সে সময়ে গেয়ো তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত

ছিহ কুলখুকি তুমি সবায়ের আদর কুড়োও
যার-তার সাথে গিয়ে যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ো
চারিদিকে কটাচোখো ধ্রুপদি জোচ্চোর সব নজর রাখছে মনে রেখো

আমি তো স্ট্রেচারবাহী কিছুই করতে পারব না
হয়তো টিফিন-বাক্সে এনে দেব রুটি আর আলুজিরে ভাজা
    গান শোনাবার মাঝে ঝুঁকে ঝুঁকে পয়সা কুড়োবে
ভোর হলে গঙ্গার পাড়ে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বমি কোরো
    হাসপাতালেতে পাবে বেডপ্যান গ্লুকোজ বোতলে জল
তেলছিটে বিছানায় পাশে শোয়া ঘুমন্ত কুকুর।
 ( ১৭ অঘ্রাণ ১৩৯২ )

শুদ্ধ চেতনার রহস্য
ঠিক আছে, লাফাও
অ্যালুমিনিয়াম-ফ্রেম কাচের জানালা খুলে কুড়ি তলা থেকে
বাতাসে ঝাঁপাও তুমি টাঙাইল আঁচল উড়িয়ে
শূন্যে ভাসবে কালো ঢাল এলোকেশ
দুপায়ে অচেনা নাচে পৃথিবীর রঙিন মাটিতে
নেমে এসো তুমি
তখন খামচে দেখো হাওয়ার শরীর কীরকম
খেলবে তোমাকে নিয়ে ওলোট-পালোট
আমার পায়ের কাছে পড়ে তুমি ছত্রখান হও
খণ্ড-বিখণ্ড হাড় থ্যাঁতা-মাংস নাড়িভুড়ি সব একাকার
ঠোঁট যোনি উরু নাভি পাছা স্তন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে
সৌন্দর্য-বিমূর্ত ক্বাথে মাছির খোরাক হবে তুমি
সব জড়ো করে তবু তুমি নও
তুমি সেসময়ে রৌদ্রে ভাসমান
বুঝেছিলে মিথ্যে এই অধঃপতন। 
২১ আষাঢ় ১৩৯২ 

দোটানা
ফেরার সময় ওরা ঘিরে ধরে। ছ'সাতজন। প্রত্যেকরই
রয়েছে কিছু-নাকিছু হাতে। আসার সময় জানতুম আজ
গোলমাল হবে তাই তৈরি হয়েই এসেছি। তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাবব না, সেটা ঠিক করা আছে।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, 'পরেম করতধে এয়েচো
এপাড়ায়! কেন? নিজের বাড়িতে মাগ নেই নাকি।'

দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি। তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে যেটা হাত দিয়ে টের পাই।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি। মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি---
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় 'ছিদাম' লেখা একপিঠে 'মাকালী' ওপিঠে।
জটলা ছিৎরে যায়। চাকু০-দেবতার নামে কতগুণ আছে
সকলে জানে না। মানব কেন অমন কুচুটে?
প্রেমিকের জন্য কোনো ভালোবাসা নেই? এই যে ছ'সাতজন
মনের স্বামিত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটু ঝলকে !
২৯ আষাঢ় ১৩৯২ 

ছি কলকাতা
থাকো তুমি তোমার ওই হিজড়েদের নিয়ে
তুমি তো তাদের আয়া স্বপ্নে যারা বর্ষাকালে বিছানায় মোতে
ইজের বদল করো ঠ্যাঙ তুলে
ফড়েরা পেচ্ছাপ করবে বলে তুমি দেয়ালে মহৎকথা লেখো
তোমার ব্যাপারে আর থাকতে চাই না আমি
তোমাকে চুম্বন করলে মৃত্যুর পরেও জানি টকে থাকবে মুখ
যেও গিয়ে কেরানি বিপ্লব করো বি-বা-দী পাড়ায়
তোমার খুলির ফাঁকে কেবলই পয়সা ফেলতা ডাকো তুমি

আমি তো মনুষ্যতর দানো
অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্হিতিস্হাপকতা নিয়ে জাপটে পিষে দিতে পারি
পায়েতে পাথর বেঁধে ফেলে দিতে পারি এঁদো পুকুরে-ডোবায়
তোমার ঘরেতে ঢুকলে দালালের টোকা পড়বে দরোজায়
"জলদি সারো আরও দু'জন বায়না দিয়েছে।"
১৭ বৈশাখ ১৩৯২

বিজ্ঞানসম্মত কীর্তি
ফ্যান টাঙাবার ওই খালি হুক থেকে
কন্ঠে নাইলন দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ো
কপাট ভেজিয়ে দরোজার চুপিসাড়ে
উঁচুতানে রেডিও চালিয়ে তাড়াতাড়ি
শাড়িশায়া জামা খুলে টুলের ওপরে
দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস-রশি পরে নিয়ো
সারারাত অন্ধকারে একা ঝুলে থেকো
চোখ ঠিকরিয়ে জিভ বাইরে বেরোনো
দু'পাশে বেহুঁশ দুই বাহু আর স্তন
জমাট ষোড়শী শূন্য পায়ের তলায়
পৃথিবীর ধরা-ছোঁয়া ছাড়িয়ে যেখানে
বহু পুরুষের ঠোঁটে আদর খেয়েছো
সে-শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ

দোলো লাশ নামাবার জন্যে আছি আমি। 
১৯ শ্রাবণ ১৩৯২

শিল্পোন্নয়ন
এ খি তুমি এইখানে পাগলাগারদে
পায়েতে শেকলবাঁধা নেয়ারের খাতে
উদোম উলঙ্গ শুয়ে আছো চুলে জট
নোংরা নখ বেড়ে গেছে দু'চোখে ঢুলুনি
সারাঘর বমি মুত পায়খানা ভরা
ভাতমাখা এনামেল থালা এক কোণে
শরীর ধোওনি জলে নেমে কতদিন
চেনাই যায় না এক কালে পাঁচতারা
হোটেলে নেচেছো নাভি নিতম্ব কাঁপিয়ে

আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচব সকলে তুর্কি গাঁজা ভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নমে যাক।   
২১ শ্রাবণ ১৩৯২

 বাজারিনী
বিশ বছরের পর এলে তুমি। তোমার আদুরে ভাষা পালটে গিয়েছে
বারবার। জানি তুমি শুভ্রা রায় নও। ওরকমভাবে একঠায়ে
সারাদিন মাথা নিচু করে বসে থাকো। আমার চুলেতে পাক
ধরে গেছে। শেখাও তোমার ভাষা এইবার। দেখি কীরকম
ঠোঁট নড়ে নাভি খিলখিল কেঁপে হেসে কুটি হয়।যুবকেরা
ঘিরে থাকে বহুক্ষণ তোমায় আড়াল করে। কিসের কথা যে এধ হয়
কিছুই বুঝি না। অন্তত কুড়ি বছরের ছোট হবে তুমি।
জানি না কাদের জন্যে অন্ন আনাজ সংগ্রহে আজ এলোচুলে
নেমেছ বাজারে। লুবাতাসে রোদেপুড়ে কালো হয়ে যাবে শেষে।
তুমুল বৃষ্টির মাঝে কীভাবে বাসায় ফেরো? ওই যুবকেরা
ছাতা ধরে মাথার ওপরে? বাড়ি ফিরে ভিজে চুল বোধায় শোকাও একা।
সকালে কি রান্না করে আসো? সেগুলোই রাতে খাও?
শরীর খারাপ হলে কারা দ্যাখে ? কে কাপড় কাচে?

আমার সন্ত্রাসবাজি রাহাজানি লুটমারথেকে জানি তোমার দুনিয়া
আলাদা একদম। তোমাকে নিজের নাম বলতে পারি না আমি।
যদি ঘেন্না করো, জেনে যাও কী-কী করি, ভয় পাও।
কতদিন ইচ্ছে হয় সামান্য ইশারা করে আমার দলের লোকেদের
তোমাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিতে বলি।
দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি। বলবে, 'আমাকে যেতে দিন'।
২৮ আষাঢ় ১৩৯২ 

পরবর্তী সর্বনাশ
পাহাড়ের বাঁকে ট্রেন দেখা গেছে যাও
এই বেলা ঘুমে অচেতন গৃহস্হালি
ফেলে ছোটো মাথা পেতে দিতে রেলপথে
এর পর রাতে আর কোনো ট্রেন নেই
পিষে কেটে ছ'টুকরো হয়ে যাও তুমি
শাঁখা-পলা গুঁড়ো হয়ে মিশুক মাটিতে
তলপেটে রাখা ভ্রুণ নিসর্গে ফিরুক
ট্রেনের পয়ার ছন্দে নিজেকে ভুলিয়ে
তোলপাড় করে দাও সুখের সংসার
ভয় দুঃখ শোক গ্লানি দিয়ে বন্ধ করো
অমল আনন্দ শেষ হোক ভাঙা ঘুমে
দধ'হাত বাড়িয়ে সারারাত রেলপথ
শিশির উপেক্ষা করে তোমার শরীর
পাবে বলে ঠায় জেগে আছে সন্ধে থেকে ।
২০ শ্রাবণ ১৩৯২ 

ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
শেষরাতে পাশ ধেকে কখন উঠেছ
চুপচাপ আলমারি ভেঙে কী অ্যাসিড
ঢকঢক করে গিলে মরছ এখন
আলজিভ খসে গেছে দু'গালে কোটর
মাড়িদাঁত দেখা যায় কষেতে বইছে
গাঢ় ফেনা হাঁটুতে ধরেছে খিঁচ ব্যথা
চুল আলুথালু বেনারসি শাড়ি সায়া
রক্তে জবজবে মুঠোতে কাজললতা
শোলার মুকুট রক্ত-মাখা একপাশে
কী করে করেছ সহ্য জানতে পারিনি
শুনতে পাইনি কোনো চাপা চিৎকার
তবে কেন সায় দিয়েছিলে ঘাড় নেড়ে
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে
২২ শ্রাবণ ১৩৯১ 

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

হাততালি -- একটি পোস্টমডার্ন কবিতা

( শ্রীমতী মীরা বেনুগোপালনের জন্য, যিনি প্রথম পরিচয়ের দিনই আমায় বলেছিলেন যে তাঁর ইউটেরাস নেই । তাঁর জন্যে লেখা এটি একটি প্রেমের কবিতা। প্রেমের কবিতাকে, তাঁরই সাহায্যে, আমি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদল-আদরা দেবার প্রয়াস করেছি। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলুম পুস্তিকাটি। দুর্ভাগ্যবশত কবিতা-পুস্তিকাটির প্রডাকশান ভালো হয়নি।তিনি তবু পুস্তিকাটি আনন্দে গ্রহণ করেছিলেন, যেমন আমাকে। )

তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
পইপই বারণের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
দগদগে রোদে
চন্দন-রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
হাহ
রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেননি হাততালি
চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা


একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে
যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছিল লালশালু নৌকোর হাততালি
না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে
গরম আলকাৎরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা
যখন নরুন-খোদাই বাতাসে
নিকেল চকচকে বিচিবীজ
কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি
ঘাসফুলে না-ফোঁপানো ফড়িং-পুরুষ
বারবাডোজ-পেশির ব্রোঞ্জপুরুষরা
জরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে


চিরুনিধার বৃষ্টিতে
ভুরু কোঁচকানো ঢেউয়ে শুয়ে
জলকে থাপড়েছে ডিজেল-চাদর ছায়া
সমস্ত ডানা সরিয়ে ফেলা হয়েছে আকাশ থেকে
হরিবোল দিতে-দিতে সাংবাদিকের সদ্যছাপা সকাল
চাবির ঘোলাটে ফুটোয় যাবজ্জীবন কয়েদির চোখ
বাইরে
হেমন্তের ঢেঁকিতে গোলাপ-গোড়ালি
লালুং রমণী


ঘামসুগন্ধে বিহ্বল প্রতিধ্বনি ফেরত চেঁচাতে ভুলে যায়
তারপর
অপারেশন বুলশিট
মুখে ঘা
শহিদ চবুতরায় অর্ধনমিত লিঙ্গে যুবাবিপ্লবীর শীৎকার পেঁয়াজবাটায় ভেজা আমিষ হৃদয়
চোখে কালি হাসনুহানা
জলে ভিজে পদ্মফুলের নিউমোনিয়া
হুঁকোটানা বুড়ো রেলগাড়িতে মেঘের চেষ্টাকৃত গর্জন
আর সোনার মাকড়সার জালে ঢাকা বিদ্যুৎ
হোঁতকা মরদকে সবুজ পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে ব্যাঙযুবতী


ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি
উত্তরমুখো নকশিমেঘের ওষুধ বড়ি গিলিয়েছে
রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটি পোকা
এলোচুলে ঢাকা উল্কামুখ রাজকন্যের মুকুট থেকে গানের টুকরো
পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস
যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল
সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানখেত
তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহ চামড়া শিকারির গোপন ঘাসপথবিয়াহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি
হেই হো


কিছুটা অপরিচিত থাকার কষ্টে 
যে-বাগান সুপুরিগাছকে কড়ে আঙুলে দাঁড় করিয়ে আজীবন
দূরপাল্লার ঝড়ে
ল্যাম্পপোস্টের নীচে
বৃষ্টি মুড়িদিয়ে
সেই ভাঙচুর চেহারাই তাঁর আঙ্গিক
যে-আদল খুঁজেছে শরীর এলিয়ে দেয়া ঢেউ
কথকনাচে বাঁধা ব্রহ্মাণ্ড
মন্দিরের চোরাকুঠুরিতে মুখবাঁধা
হাততালি


আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে
যেটুকু সময়ে
আলজিভ
দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে
জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী
গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের সখ্যতা
ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন
শেষ হাওয়ায়
পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ
যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি


রাতভর ছড়ানো হাততালি সকালে এককোণে ঝেঁটিয়েছে ঝাড়ুদার
আঘাতহীন ভালোবাসায়
থলেতে পুরেছে অসুস্হ গঙ্গানদীকে
এক বা তিনরঙা পতপতে রামধনু
কবরে পাওয়া গেছে ভাতখাবার কাঁসি
অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান
কেউ সুখী নয়
কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে
ভালো
পাকের পর পাক কোমর থেকে কাঁটাতার খুলে দিয়েছে


নষ্টের শপথ আওড়ানো শেষে
শহরগ্রামে রোঁদে বেরিয়েছে মড়াসংগ্রহকারী
কষ্ট হলে কাঁদতে পারার আশীর্বাদ চেয়েছে নগরবাসী
ওদিকে হাততালিবাদক
ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশপাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে
তারা দপদপে অন্ধকারে
বালিশ-জড়ানো বর্ষায়
পালামৌ জেহানাবাদ রোহতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি
শামুক-থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক


আধপচা হুগলি নদীর ডাগরচোখ পারশের গান শুনতে
কেউটে যুবতীর শরীর থেকে খসে পড়েছিল শীতের মিহিন আদল
আচমকা সজারু
বিয়ের লাল বেনারসিতে শিমুল
এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী
গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া
ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা
তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি
হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে
টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠকঠক ঠকঠক ঠকঠক


( মুম্বাই ১২ মাঘ ১৩৯৫ )
পোস্টমডার্ন কবিতার জনক ফেদেরিকো দ্য ওনিস



বুধবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

'কৌণপের লুচিমাংস' কাব্যগ্রন্হ থেকে

'কৌনপের লুচিমাংস' কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলো হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার ৩৫-৪০ বছর পর লেখা

টাপোরি

আমি যে-কিনা পালটিমারা তিতিরের ছররা খাওয়া আকাশ
জলে ডোবা ফানুসপেট মোষের শিং থেকে জন্মেছিলুম
অলসচোখ দুপুরে পুঁতি-ঝলমলে নিম-গাছটার তলায়
থাবা-তুলতুলে আদর খাচ্ছিলুম ভুরু-ফুরফুরে শ্যামাঙ্গী গৌরীর
হাতখোঁপায় গোঁজা বৃষ্টির কাছে নতশির স্বর্ণচাঁপার কোলে

আমি যে-কিনা গ্রিলবসানো সকালমেঠো দিগন্তে দাঙড়িয়ে
মাড়ানো ঘাসের পদচিহ্ণ-আঁকা শোকাচ্ছন্ন রোদের সোঁদাভূমিতে
শেষ গড়াগড়ির বিছানায় কাঠকীটের রাতঘ্যাঙোর শুনেছি
ভাবছিলুম উদ্দেশ্য প্রণোদিত হলেই খারাপ হতে যাবে কেন রে
পদ অলঙ্কৃত গতরের ঘামে কি খাটুনির লবণকলা নেই

আমি যে কিনা ডাহুককে জিজ্ঞেস করেছি প্রজাপতির ডানায় কী স্বাদ পাস
কানপটিতে খুরধ্বনি সেঁটে চিপকো খেলার তেজবরে কনের আদলে
জাহাজ-এড়ানো লাইটহাউসের আলোয় এক করাতদেঁতো হাঙর
যামিনী রায়ের আঁকা স্তনের কেরানির সঙ্গে মহাকরণের খাঁচালিফটে
হেঁকেছিলুম আরোহী-ফেলা পুংঘোড়ার লাগামছেঁড়া হ্রেষা

আমি যে কিনা উচ্চিংড়ের স্বরলিপিতে গাওয়া ফুসফাসুরে গান
বেড়াজালের হাজার যোনি মেলে ধরে রেখেছি ইলশে ঝাঁকের বর্ণালী
স্বদেশি আন্দোলনের লাশঝোলা স্মৃতির গাবগাছের পাশের ঝোপে
শুকপোকায় কুরেখাওয়া লেবুপাতার পারফিউমড কিনার বরাবর
পাথরকুচি কারখানা-মালিকের ঘাড়কামানো পাহাড় থেকে উড়ছি
(কলকাতা, ১ মার্চ ১৯৯০)

অভ্রপুষ্প

মোচড়খোলা আলোয় আকাশকে এক জায়গায় জড়ো করে
ফড়িং-ফোসলানো মুসুরিখেতে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন বোলডার-নিতম্ব কবি

মরাবাতাসের বদবুমাখা কন্ঠস্বরে ঝরছিল বঁড়শিকেঁচোর কয়েলখোলা
গান থেকে এক-সিটিঙে সূর্যের যতখানি রোজগার

শেষ হয়ে যায় মধু দিয়ে সেলাইকরা মৌচাকে মোতায়েন জেড ক্যাটাগরির
ভোঁদড়ের খলিফা-আত্মা সামলাতে

প্রদূষণ-বিরোধীদের দিকে ছোঁড়া কাঁদানে গ্যাসের হাসি চুয়ে পড়ছিল
লিপস্টিক বোলানো গোধূলি থেকে চুলকুনি-জালে বানানো চামড়ায়

ভুটভুটির মাঝি-মেকানিক তখন ফ্রিজের কুমড়োর শীতঘুম থেকে উঠে
দুচার ক্রেট নদী ভরেছে ডটপেনের নীল শিরদাঁড়ায়

যার ফলে আঙুলের ডগায় লেগে থাকা স্মৃতিতে খুঁজে পাওয়া গেছে
হারানো চাবির বিকল্প এক আয়ুর্বেদিক জ্যোৎস্না

মাথার ওপর বয়ে নিয়ে চলেছে বোরখাঢাকা মেঘের মধ্যে
পালকখোলা টিয়াদের জোয়ারে হেলান দেয়া গেঁহুয়াপিঠ ঢেউ
( পাটনা, ৬ জুন ১৯৯৮ )  

ওপার

পালঙ্কের নরম হ্রদটির কেচ্ছা না-থাকার দুঃখে
               দুলছিল হেলিকপ্টার নাচানো সোনালি ধানখেত 
ফলে শীষের গোছায় পাতকো ঝোঁকা বালকদের চোখে
               নক্ষত্রগুলো আর একদম থাকতে চায়নি
মানা যায় এরকম উপদেশের অভাবে কাদাচিকন -কোমর       
গুটিকয় কাঁটাতার-কেশবতী মাঠের আলের ওপর দাঁড়িয়ে
কেউটের ডিম পাড়ার শব্দে টুসকি বাজিয়ে ডাকছিল
     আদুলগা প্রতিধ্বনির বৈঠা-বাওয়া বকদম্পতিকে
কাঁধে ওদের জোয়ালের দাগ যার ভারে লোলচর্ম অন্ধ আকাশপথ
চিৎকার করছিল রাস্তা পার করে দাও রাস্তা পার করে দাও
রাস্তা পার করে দাও রাস্তা পার করে দাও
 (কলকাতা ৭ মার্চ ১৯৯৮ )

ভূমিকা বদল

হাই তুলতে-থাকা থুতনির তিলে
বিষে নেতিয়ে আছে যে বিকেল
        কিস্তিতে কেনা আদরের বেড়াজাল
        কচুপাতার টলটলে সবুজ নাভিতে তা
অল্পস্বল্প ঢিলেঢালা প্রতিধ্বনি মিশিয়ে
মাখিয়ে দিন ঝিনচাক দেদোল দেহে
        ব্যাস হারানো জিনিসের বিকল্প পাবেন
        চাউনির অভিযোগ থেকে পোঁ-পোঁ বেরিয়ে
ডুমোডুমো করে কাটা কথাবাত্রায়
চুবিয়ে নিন প্রজাপতি-গর্ভের ডিজেল
        খুজলি-খচিত কানের মাকড়সাকে বলুন
        রংচটা আঁখি-উলির কী রেট যাচ্ছে হে
ও-ই আনবে নিরুদ্দেশ নুড়ির জলস্মৃতি
আর রয়াল বেঙ্গল খচ্চর-ডাক
        কাঁচিতে-কাটা পুকুরের পানাচাদর গায়ে
        আখের রসকে পালটান খেজুর-পাটালিতে
ঠিক করুন কী নাম ধরে ওকে ডাকা হবে
যদিও ফি-সন্ধ্যায় বেশ্যাদের নাম-বদল হয়
        ধুলো-মাখা উরু ঝেড়ে উড়োনো কুয়াশায়
ও ও ও ও ওয়েস্ট উইন্ড ফেরত যাও পচ্ছিমে
জোয়ার তো গা-জোয়ারি তামাদি করেছে
 (পুণে ১৫ আগস্ট ১৯৯৮)

সাঁকো বাঁধা যায় না এমন ওপার

সোমবার অফিস-টাইমে মড়াপোড়া হাওয়ায় আচমকা সেঁদিয়ে
যে-পুরুতের দেয়া সব বিয়ে ভেঙে গেছে

চড়ুইদের বিতর্কসভায় ফুড়ুৎবাদী মণ্ডপে বসে মজাসসে জানালেন
প্রেম যাদের রাতঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়

তাদের চেটোর আঁকিবুকিতে একা থাকার চুলকুনি বহাল রইল
সবাই তো নিজস্ব নোংরামিতে ঢালাই-করা

ঢোকো বা না ঢোকো ভালোবাসার আছে একটিমাত্র ঝাঁচকচকে কানাগলি
যে-উৎসবে কয়েকটা শতক ঠাসা থাকে তাতে

বাঙালির ভবিষ্যবাণী শোনায় ঝাঁকঝাঁক গোলাপিগলা শকুন
যাদের জিভের ছোঁয়ায় মায়ের ভাষা পচছে

তাদের দয়ায় সুবিধে এই যে কলকাতা শহরে কারোর মরতে ইচ্ছে করেনা
কেননা প্রতিশোধ তো আদরের রাজা

তাইতো হাত হাতকড়ার স্মৃতি ভুলে বোলতার মেটেবাড়ি অহরহ খোঁচায়
ফলে রাজার কুকাজের ভাগিদার না হয়ে প্রজার উপায় কই

পরস্পরকে ছিঁড়ে যত আলাদা করবে তত সম্পর্ক দিনকেদিন গজাবে
বছর-বছর আহ্বান মুলতুবির এইটেই মজা
 (কলকাতা ৪ মার্চ ২০০০)



জীবনস্মৃতি

পেছনপানে হেলে-পড়া ছায়া গুটিয়ে কোকিলঠাসা অন্ধকারে
চুপচাপ বসেছিলেন প্রেমিকার সামনে জীবনে প্রথম উলঙ্গ প্রেমিক
পাখিগুলোর দ্বিস্বর কন্ঠ ঝর্ণার তোতলামি ফুটিয়ে ওকে বলেছিল
আমাদের দুধ-সফেদ গান কিনলে ছাড় পাবেন
প্রেমিকের দুচোখের নবজাতক-ভাসানো নদীতে যে-গ্ল্যামারকন্যা সাঁতরাচ্ছিলেন
তলপেটে বাদুড়ব্যস্ত কলকাতার গোধুলি মেখে
তাঁর পতনকালীন পয়ের পাতায় কয়েকটা ঘাড়-গোঁজড়ানো শোকার্ত শকুন
তাকিয়েছিল স্ক্রিন টেস্ট-করা স্তনের দিকে
যার বোঁটায় নবদম্পতি ফড়িংজোড় অতীতকে খরচ করার ধান্দায়
হিসেব কষছিল আজ আর কালের মাঝে ক্ষয় আর বৃদ্ধি
কিন্তু কচুডাঁটায় চেপকানো গেঁড়িদের পিনকোড-দূরত্বের
পুকুরে প্রেমিকের পায়ে ঠেকেছে শ্যাওলা-সুনসান জাহাজডুবি
আর ওর ফেরত-দেয়া অভিশাপে হাসপাতাল-ট্রেডমিলে বুড়ো তীর্থযাত্রীরা
এমনধারা শেকড়তোলা নাচ নাচছিল
যেন তাদের মাকড়জালে ঢাকা আয়নায় দেখা হাঁ-মুখ থেকে ভুটভুটিধোঁয়ায়
ফরস্টুন-ওড়ানো সিংহগর্জনের শেযতম রেশ চলছে
( কলকাতা ২ মার্চ ১৯৯৮ )

কাউন্টার ডিসকোর্স 

সমুদ্রের নোনাডাক লাগাতার বলছিল আমি আর আগের মতো নেই রে
নেই কেননা হাসপাতালে বিছানার রেলিঙে আমার পা বেঁধে দেবার পর

খাটের দুপাশ দিয়ে আলাদা বয়ে যাচ্ছিল মজুরের নদী কৃষকের নদী
যে-কড়াকড়িতে সারাদিনে সূর্য শুধু একবারই ওঠে আর মিলিয়ে যায়

উদাহরণ দিতে হলে বলতে হয় এ তো ব্যাঙ আর কাউটের শুভদৃষ্টি
যখন বীজের আধভেজা খোসা শেষবার জড়িয়ে ধরেছে অঙ্কুরকে

আমি জানতুম আমি আর আগের মতো নেই রে সব শব্দেরই তালাখোলা শেষ
দিনকাল এমন পড়েছে যে গোলাপের গোড়ায় ঋষির হাড়গুঁড়ো না দিলে ফোটে না

আর কেউ শালা আকাশের এক কোণে পিক ফেলে কেটে পড়েছে
হতে পারে...হতে পারে...কাকতাড়ুয়ার ওপর বসে থাকা দাঁড়কাকটা

আশ্বিন-দুপুরের কাঁথাস্টিচ-করা পুকুরের জল থেকে
আমি ইয়ার নিজের শেষ ছায়াটুকু চাঁচপোঁছ করে তুলে নিয়েছি
( কলকাতা ৩০ মার্চ ২০০০ ) 

আমার জিগরি দোস্ত ফ্যাটুল চিঠিপাধ্যায়
দোষ-নির্দোষের মাঝে আটক আমার জিগরি দোস্ত ফ্যাটুল চিঠিপাধ্যায়
ওর হাঙর-হাসি মুখ ভেঙচে বাছুরের চামড়ায় বাঁধানো ভাগবতে
হাত রেখে শপথ করেছিল যে, ফাঁকা চেয়ারগুলোয় যে-অদৃশ্য লোকেরা
বসে থাকে তাদের বলবে: "সময় ব্যাটাই বন্ধু সেজে ভয় দেখায়"

কাঠঠোকরার বাসার ফুটোয় ঝড়ের ঢঙে ঠোঁট রেখে বাঁশি বাজাচ্ছিল ফ্যাটুল
বেচারার বগলে ঘামের কাতুকুতু ছাড়া জীবনে আর কোনো আহ্লাদ ছিল না

ভালোবাসার লোকজন একে-একে হাপিশ হবার পর নিয়তির তাড়া খেয়ে
ইতিহাসেই আছে উত্তরণ জেনে বাদুড়রা যখন ওর মাথা ঘিরে ঠা-ঠা হাসছে
নিজের কুকুরকানে শুনল: "সময়ের মতন মান-হানিকর বজ্জাত আর নেই"
যে-লোকই পাশে শুয়ে শ্বাস নিয়েছে সে-দেখি অসৎবাজ বেরিয়েছে

গ্রন্থকীটের পরাগমাখা রুপোলি আঙুল বুলিয়ে ভেবেছে শব্দই স্রেফ সার্বভৌম
বাদবাকি লোকেরা কান্না ফুরোবার অপেক্ষায় শবখাটের বাহক
বাচারা জানত না 'অর্কিড' শব্দটা গ্রিক অর্কিস মানে অণ্ডকোষ থেকে এসচে
তাই জগৎটাকে চিরকাল দেখেছে ছাড়ানো নারকোলের মরচে-পড়া চোখ মেলে 
 ( মুম্বাই ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০০ ) 

শূন্যগর্ভ
বাতাসবোনা ঘাসখেতে কানের লতিতে ধুলো মেখে
    আমাকে ঘিরে যখন কেউটে শিশুরা নাচতে আরম্ভ করেছে
খসখে অন্ধকারে উদোম তর্জনী তুলে
    দেখলুম বৃষ্টির ফিসফিসানির মাঝে সূর্য ওঠার রিনরিন বাজনা
এমন মৃদু রাইফেলের ফুটোয় দেখা চারচৌকো জগৎসংসার
    তাকে ঘিরে রেখেছে
কাঁতার মুকুটপরা স্লোগানসিক্ত পাঁচিল


ওই বাগান এগিয়ে এসে আমায় আপ্যায়ন করার পর
    ঘাসে-ঘাসে পড়ে আছে কেউটে মা-বাপের নাচের নূপুর
আর কেউটে গৃহিনী বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন
    আসল জিনিস চাইলে তাও খুলে দেখাতে পারি


তাকিয়ে-তাকিয়ে যে-নারীর কৌমার্য নষ্ট করে দিয়েছিলুম
    তারই মোচড়ানো হাতের অযৌন আলিঙ্গনে চোখে পড়ল
কাঁকড়ার আলোতরল বুকে আমার ঠিকুজির ছককাটা আছে
    যা চুমু-চিকন ঠোঁটে চেটে নিয়েছিলেন কেউটে গৃহবধু


মেনু-ছাপানো শ্রাদ্ধবাসরের হাসিখুশি শোকে
    নিজের গা থেকে ছায়া চেটে বাজারের ব্যামোকুকুর
আর তখনই বিস্কুটের ঘুঁড়ো-ছড়ানো মানচিত্রে
    একদেশ থেকে আরেকদেশে চলে যাচ্ছিল পিঁপড়ের সার
( আহমেদনগর ১২ অক্টোবর ১৯৯৭ )

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা
আমি তো বলতে গেলে দাঁতনখের চাষ ছেড়ে সাজলুম প্লাইকাঠের নেতা
ছদ্মবেশ ধরলে দেখি আসল ছেহারাখানা বেরিয়ে পড়েছে রে
স্ববিরোধিতা ছাড়া কি আর অন্য কোনো মৌলিক কাজ আছে ? বল!

আমি তো বলতে গেলে জরাজীর্ণ আকাশ জুড়ে ঢিললা-চিল বুড়ো
ভান করার ভান করি আর তা জীবন নামে চালাই
সাঁতারু-খেলানো জলে নৌকোর ছইয়ে সংসার পেতেছি


আমি তো বলতে গেলে পাষাণ-রিদয় পাথর ভেঙে দেখি
বালি-ঝুরঝুর চাউনি মেলে কাছিমখেকো বেতোরুগির দল
জলে ডোবা পাঙাশ মেয়ের ঠোঁটে ডানাউড়াল হাসি খুজছে


আমি তো বলতে গেলে গৃতাহুতির ভেজাল ধোঁয়ায় কেঁদে
সত্য বানাই মৃত্যু বানাই হুর্ধ-অধ গোলচক্কোর বানাই
সাপটা ছিল নিজের গর্তে হাত ঢুকুয়ে তাকেও তো ভুল বোঝাই
( কলকাতা ২৭ নভেম্বর ১৯৯৯ )

রূপসী বাংলার ভাতার
আমি যে কিনা ফসফেটে ন্যাতা ঝিঁঝির চোখে ডিঙি-ভাসানো রোদ্দুর
মরা কলাবোসের ডিম্বদৃষ্টি মেলে নরীবিহীন বাড়ির জোড়াখাটে
চুলের নুটি-জড়ানো রজনীগন্ধা গোছার তলায় বদগন্ধ তক্তাবুক লাশ
হাত দুটো দুপাশে মরে পড়ে আছে বলে ঠোঁটের মাছি ওঢ়াতে পারছি না
সান্নিধ্যের দূরত্ব ঘিরে অফুরন্ত অবসরের নেকড়ে-চাউনি জ্ঞাতিদের ভিড়

আমি যে-কিনা কুহকঠুঁটো মেয়েদের মাঝে ছিলুম ট্রিগারলিঙ্গ যুবা
খড়খেতের সোঁদাসোনালি চামচমকানো
মকাইগুঁফো চাষার ছেলে
একটা চুল টানতেই শিরশিরিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রক্তপচা আঁতের ঝুরি
জ্ঞাতিদের মুখে পাঁঠার গলায় নেবে-আসা
খাঁড়ায়-আঁকা চোখের কান্না
দেখছি আর ভাবছি কী যে মজা ওফ শবশকটে আগা চাপিনি কক্ষুনো
( কলকাতা ১৫ আগস্ট ১৯৯৯ ) 

পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বাঁচাতে হলে
কেন জানি না আমি
        হাঙরপেটের গোলাপি-জীবনের পাগলাগারদে
আপদ-বিপদ পিষ মানিয়ে বিপথগামী বৃষ্টিতে ভেজা গলির সৎপথে
কাঁধে অন্ধকার বয়ে ২০৫নং রুটের বাসটা যখুন বাবুঘাট পৌঁছোল
ড্রাইভার বললে ওপারে সামলে যান নদী গেছে সমুদ্রে মাছ বিয়োবার ধান্দায়
জানেন তো বাসিমড়া ছাড়া আর-সবায়ের শবযাত্রায় নিষেধ লেগেচে

কেন জানি না আমি
        প্রবেশ নিষেধ লটকানো এলাকায় যেখানে বজ্জাতরা জেতে
কানের লতিতে আগাছাঅলা ক্রেটারমুখো সাংবাদিককে দেখলুম গুণছে
দুঃশাসনের ব্যথাবিহীন হাত দিয়ে বিদ্যুৎচুল্লিতে জমা শেষনিঃশ্বাসের ছাই
যাদের পেশা ছিল ছারপোকার মাতৃভূমিতে যুক্তি দিয়ে অন্যের মতখণ্ডন

কেন জানি না আমি
        গুজবে কান না-দিয়ে যারা জিভ দেয়াটাই ভালো মনে করে
তারা যখন অশান্তিকে শান্তি বলে মেনে নেবার জন্যে থাকাখাওয়া ফ্রি করে দিলে
স্বনামের কবর থেকে বেরিয়ে এল জয়যাত্রা নামের বিষকালি-মাখা খোঁয়াড়
সবাই চেল্লাচ্ছিল বিপ্লব চাই বিপ্লব চাই কিন্তু চাকরিতে বদলি চাই না

কেন জানি না আমি
        প্রেমিক-বর্জিতা গর্ভবতী যেদিন ব্যাঙডাক প্রতিধ্বনিত কুয়োয়
ভেসে উঠল---খুনির ব্যবহৃত স্মৃতিভারাক্রান্ত বাটখারাটি মুদির দোকানে
সত্যনারাণের সিন্নির জন্যে আটা ওজন করাতে সাহায্য করছিল
হাবভাব তো এমন যেন ডাঙায় তোলা মাছকে দখিনা বাতাস কাতুকুতু দিচ্ছে

কেন জানি না আমি
        আঘাত তার ব্যথার স্মৃতি যত দ্রুত ভোলে তারচে তাড়াতাড়ি
দেখলুম লাশের কপাল বেয়ে সন্দেশচুরো মুখে শ্মশানপিঁপড়ের মিছিল
( মুম্বাই ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ )

ঘুসপইঠি
আমি এমনকী ব্রিটিশদের টুকরোটাকরা-ঠাসা অতীত ঝেড়ে
অন্ধস্কুলের দেয়ালে দেখি লেখা গুটিকয় তালঠুকুয়া জ্ঞানের স্লোগান
হাতড়ে দেখি আরে ক্ষীরের সিঙাড়ার হালুয়ায় পুর-দেয়া কানামাছি
চাঁদবণিক প্রায়ভেট নামে বিশ্বায়নের পার্লার খুলেছে

আমি এমনকী কোকিলটাকে বলেছি তোর নাম যে কোকিল তা কি জানিস
কইমাছও তো জানে না যে বাজারে ল্যাংটোপোঁদে ও দুরুদুরু-বুক কইমাছ
ভুষিমালের প্রতীক নিয়ে করবিটা কী নতুন বলতে কিসসু বাকি নেই রে

আমি এমনকী শালবনের রিমিক্স নাচের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে
খাঁজকাটা রোদ্দুরের ডালেডালে অক্ষয় বয়স্ক চিল রেখেছি দফায়-দফায়
যাতে একটানা ডেকে-ডেকে রাতটাকে বাড়াতে পারে কুকুর সমাবেশ

আমি এমনকী মানব-সন্তানদের হিসিভেজা মফসসলি ইসটিশানে
মাগিপিয়াসী নিত্যযাত্রীদের আত্মা-মেরামতের নাইটশিফট কারখানায়
মানুষ কাকে বলে জানতে আয়নাভাঙা টুকরোর মুখগুলো ওজন করাতে গিয়ে
টের পেলুম সত্যকে জানতে হলে ভাষার বাইরে লাইন দিতে হবে রে
(  কলকাতা ২৫ নভেম্বর ১৯৯৮ )  

 ক্যাটাক্রিসিস
আমি কিন্তু তামাদি মনীষীদের তেলরঙা স্মৃতির বোটকা গন্ধে বসে
জলের ওংবিষ্ণু ছিটে দিয়ে শষ্যবীজের জ্ঞান ফেরাতে গিয়ে অবাক
সরকারি-স্ট্যাচুর গুদোমঘরে পরাবাস্তব জেনিটাল-টুকরো ছড়ানো ঘাসে
যাসশালা, মূর্তিভাঙা পাথরচুরো বিয়ের আগে কী নাম ছিল ভুলে গেছে

আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলুম নদীটা মাছেদের বুক ধড়ফড়ে কাহিল
পেঁকো ভাঁটার দেঁতোহাসি করোটির কাঁকড়া-ঢাকা চোখে
নেশার বোধিতে বুজে আসছে দুর্গাঠাকুরের পারিবারিক খড়পচা লাশের চাপে
যা সবাইকে এই সভ্যতা থেকে ওই সভ্যতার রোগে পথ বাতলে নিয়ে যাবে

আমি কিন্তু কুঁড়ে টাইপের বিকেলবেলায় যখন বেহেড পাকস্হলি নিয়ে ফিরছি
ভুল সময়ে আগত শীতে বদনবেচুনিদের চৌরঙ্গি স্যামপেলের ডেরায়
ম্যাপ খুলে দেখালে হ্যাঁ এই যে ওফুটে ওইতো ইউজার-ফ্রেন্ডলি বসন্তঋতু
চিলের পেছন-পেছন উড়ে ব্লোআপ হিরোর গায়ে হাত ছুঁইয়ে ভিককে চাইছে

আমি কিন্তু অতীতকে নতুন-করে গড়ে ফেলেছি জলফোঁটায় বেঁধেবেঁধে
প্রকৃতি কি আর জানতোনা লাশ গোঁজড়াতে এক সেট অমাবস্যা চাই
তাইতো জলের ক্যাঁদরায় খুকি-পোনাদের ভাগিয়ে নিয়ে চলল জোয়ার-বুড়ো
( কলকাতা ২৬ নভেম্বর ১৯৯৮ )

শেষট্রেনের নাম তত্ত্ববিশ্ব
রুপোলি স্ফুলিঙ্গমাখা চিতলন্যাজা ধামসাবাদকের আঙুলহীন মুঠোয়
    ডিমখোর ঢেউদের চাঁদবদন হল্লায় বাজছিল মৌমাছিডানার মৌতরঙ্গ
তবু ছুটন্ত সুড়ঙ্গে ষাঁড়পুরুষের মেটিংকল শুনে
    চোখের বালির খোঁজ পড়েনি নিতম্বমসৃণ ভালোবাসায়
ফলা কলকাতার সর্বজনীন আস্তাকুঁড়ের সদবিপ্র মাসিকচক্রে ফলেছে
    রাঢ়ের ওল আলো আর ভাষাভুষো
তা এখানের এই লেফটহ্যান্ডড্রাইভ দেশে কুচো-কুচো সূর্য ভাসাবে
    এই আশায় মাতালরা যাবার পর হাঁফ ছেড়েচে ঘরটা
কেঁদেছে: হায়গো তাম্রপত্রে কলঙ্ক লাগবেই
    যতই না জাঁদরেল টিকটিকি কড়িকাঠ কাঁপাক
আর ভাঁটার দুলুনি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক ক্লান্ত স্টিম লঞ্চ
    হাড়েহাড়ে টের পাওয়া হাড়গুলো দাঁতনদেঁতো প্যাংলার দুর্ভাবনায়
ডেরা ডেলে চুলখোলা বারান্দায় চোখবুজে দেখবে এক তিন ঠেঙে বেড়াল
    শ্যাওলাচাদর মুড়ি দিয়ে
প্রতিধ্বনি নকল করতে ওস্তাদ তলপেট-ফোলা বোলডার
পিঁপড়ের খনিটানেলে জড়ো করেছে টুসকি নির্দেশে
    নামিয়ে-আনা তত্ত্ববিশ্ব
 (কলকাতা ২ মার্চ ১৯৯৮ )

শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' গ্রন্হ থেকে

(এইগ্রন্থের কবিতাগুলি হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার কুড়ি বছর পর লেখা)

ঘুণপোকার সিংহাসন

ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান প্রাণী
স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকুল বিনোদিনী
শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছ এদেশে ।
 ( ২ ভাদ্র ১৩৯২ )

মনুষ্যতন্ত্র

আক্রান্ত হবার জন্যে তৈরি হয়েই আছি এসো মারমুখি চামচিকে
জামাগেঞ্জি ছিঁড়ে দাও বাড়ির দেয়ালে বোমা মারো
রগে রিভলভার চেপে ভয় দেখাও হাজতে ঠেঙিয়ে জেরা করো
ধাবমান ট্রেন থেকে ঠেলে দাও আমাকে আটকাও মেরে ফ্যালো
আমি ভূকম্পনযন্ত্র আণবিক যুদ্ধ দেখব বলে বেঁচে আছি
নীল গর্দভের লিঙ্গ মানবের শুক্রজাত কাফ্রি খচ্চর ।
( ১৬ ভাদ্র ১৩৯২ ) 

এ কেমন বৈরী

ভাবা যায় ? কোনো প্রতিপক্ষ নেই !
সবকটা আধমরা হয়ে আজ শুয়ে আছে জুতোর তলায় ?
কিছুই করিনি আমি
কেবল মুখেতে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করেছি থেকে থেকে
হাহাহা হাহাহা হাহা হাহা
পিস্তল কোমরে বাঁধা তেমনিই ছিল সঙ্গোপনে
ক্ষুর বা ভোজালি বের করিনিকো
বোমাগুলো শান্তিনিকেতনি ব্যাগে চুপচাপ যেমন-কে-তেমন পড়ে আছে

আমি তো আটঘাট বেঁধে ভেবেছি বদলা নেব নিকেশ করব একে-একে
সকলেই এত ভিতু জানতে পারিনি
একা কেউ যুঝতে পারে না বলে দল বেঁধে ঘিরে ধরেছিল
এখন ময়দান ফাঁকা
তাবৎ মাস্তান আজ গরুর চামড়ায় তৈরি জুতোর তলায়
কিংবা পালিয়েছে পাড়া ছেড়ে কোনো জ্ঞাতির খামারে
আমি তো বিধর্মী যুবা এদের পাড়ার কেউ নই
জানালার খড়খড়ি তুলে তবু যুবতীরা আমার ভুরুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে

ছ্যাঃ এরকম জয় চাইনি কখনো
এর চেয়ে সামনে শিখন্ডি রেখে জেতা ছিল ভালো

ভেবেছি চেংঘিজ খান যে-লাগাম ছেড়েছে মৃত্যুর কিছু পরে
তার রাশ টেনে ধরে চুরমার করে দেব এই সব জাল-জুয়াচুরি
আগুন লাগিয়ে দেব মাটিতে মিশিয়ে দেব ধুরন্ধর গঞ্জশহর
কিন্তু আজ সমগ্র এলাকা দেখি পড়ে আছে পায়ের তলায় ।
( ৪ মাঘ ১৩৯১ )

বাড়িদখল

দরোজায় লাথি মেরে বেহায়া চিৎকার তুলছি মাঝরাত্তিরে
যারই বাড়ি হোক এটা খুলতে হবেই নাতো ভেঙে ঢুকে যাব
সামলাও নিজস্ব স্ত্রীলোক বাঁদি সোনাদানা ইষ্টদেবতা
ফেরেবের কাগজপত্তর নথি আজ থেকে এ বাসা আমার
ভোর হলে রাস্তায় সমস্ত আসবাব ছুঁড়ে ফেলে দোব
শষ্যের গ্রীষ্মবর্ষা পাপোশের নারিকেল ছায়া পোশাকের মেঘলা দুপুর
গয়নার ভালোবাসা বাসনের দিনান্তের খিদে
সদর দরোজা দিয়ে ধাক্কা মেরে বের করে দোব
দখল করছি না আপাতত কেননা এখনও অনেক বাড়ি বাকি
( ৩ ভাদ্র ১৩৯২ )

প্রস্তুতি

কে বললে বিধ্বস্ত হয়েছি ? দাঁত-নখ নেই বলে ? ওগুলো কি খুবই
জরুরি ? আবাঁট চাকুর মেধা তলপেট লক্ষ করে বিদ্ধ করে দিয়েছি সেসব
এরই মধ্যে ভুলে গেলেন কেন! পাঁঠার মুখের কাছে
পাতাসুদ্ধ কচি এলাচের গোছা, সেই যে সেইসব কাণ্ড ? ঘৃণাশিল্প ক্রোধশিল্প
যুদ্ধশিল্প ! পিছমোড়া মুখবাঁধা যুবতী সানথাল; গোলাপি ফুসফুস ছিঁড়ে
কুখরির ধারালো আনচান -- সেইসব ?
হৃৎমাংসে রক্তমেখে উঠে আসা চাকুর গরিমা ? আমার তো গান বা
সঙ্গীত নেই; কেবল চিৎকার, যতটা হাঁ করতে পারি
নির্বাক জঙ্গলের ভেষজ সুগন্ধ; ঘুঁজি-পরিসর কিংবা হারাম-সন্ন্যাস
বলিনি, "জিভ দিন জিভ গোঙানি ফেরত নাও 
দাঁতে দাঁত দিয়ে সহ্য করার ক্ষমতা।" নির্ভীক বারুদ বলবে:
"মূর্খতাই একমাত্র শিক্ষণীয়।" উদারহস্ত নুলো
দাঁতে ছুরি নিয়ে আমি লাফিয়েছি জুয়ার টেবিলে, তোমরা ঘিরে ফ্যালো
ছেঁকে ধরো রাবার বাগিচা কফি চায়ের বাগান থেকে
গামবুটে স্বচ্ছন্দ চাকুরিসুদ্ধ এসো কে কোথায় আছো
জরাসন্ধের পুং যেভাবে বিভক্ত হয় হীরকের দ্যুতি ছলকে ওঠে
হাত-পা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর জ্ঞানগম্যি বলে কিছু নেই
বাঁশির মতন ধরে সিঁধকাঠি বাজিয়ে দেখেছি আমি অসুখে অভাবে
আপেল ত্বকের মোমরেণু-মাখা ভঙ্গুর স্নেহ
সঙ্গমের আগে মাদি পিপীলিকা ডানা খুলে রেখে দেবে পাশে
আমিও উরুত চাপড়ে বিকল্প চিৎকার দিচ্ছি: পৃথিবীকে খালি করো
বেরোও বের হও সর্বশক্তিমান
বান্দরের চুলকানিপ্রবণ চার হাতে শঙ্খ
চক্র পদ্ম গদা নিয়ে নিজের ঘামের নুনে লবণ বিদ্রোহ হোক
বারুদ সুতলি ধরে বিস্ফোরণের দিকে তুমাকার স্ফূলিঙ্গ ছুটুক
সারা গায়ে অন্ধকার লেপড়ে এসো বাকফসলের কারবারি
কুকুর-যুবার মনোমালিন্যে ভরা মাঝরাতে
কীটনাশকের ঝাঁঝে মজে থাকা ফড়িঙের রুগ্ন দুপুরে
ভূজ্ঞান সম্পন্ন কেঁচো উঠে আয়
চাকুর লাবণ্য আমি আরেকবার এ-তল্লাটে দেখাতে এসেছি।
 ( ১৯ ফাল্গুন ১৩৯১ )


মেসোমশায় পর্ব

যুধিষ্ঠির
আববে পাণ্ডবের বাচ্চা যুধিষ্ঠির
বহুতল বাড়ি থেকে নেবে আয় গলির মোড়েতে
নিআয় ল্যাংবোট কৃষ্ণ ভীম বা নকুল কে-কে আছে
পেটো হকিস্টিক ক্ষুর সোডার বোতল ছুরি সাইকেল চেন
বলেদে দ্রৌপদীকে আলসে থেকে ঝুঁকে দেখে নিক
আমার সঙ্গে আজ কিছু নেই কেউ নেই
ধৃষ্টদ্যুম্ন দুর্যোধন নেই
তোদেরই অঙ্গুলিহেলনে কেটে তর্জনীও দিয়েছি শৈশবে
দাঁড়াচ্ছি পা-ফাঁক করে দন্তস্ফূট হয়ে যাবে জয়ধ্বনি তোর
সিঁড়িতে শেকলবাঁধা মহাপ্রস্হানের কুত্তা লেলিয়েও দ্যাখ
ন্যাটা হাতে যুঝে যাব জমিন ছাড়ব না
লুমপেন বলে তোরা ঘিরে ধরবি
আরেকবার ছিটকে পড়ব ফুটপাতে মুখে গ্যাঁজলা নিয়ে
ছুটন্ত খচ্চরবাচ্চা পিঠের ওপরে ক্ষুর দেগে যাবে
নাভিতে ব্লেডের কুচি দিয়ে তোরা খোঁচা দিবি
পায়ুমুখে জ্বলন্ত সিগারেট
পাঁজরে আছড়ে পড়বে কম্বলে মোড়া সোঁটা

দেখে নিস তোরা
মাটিতে গোড়ালি ঠুকে পৃথিবীর চারিধারে জ্যোতির্বলয় গড়ে যাব ।
( ২৭ বৈশাখ ১৩৯২ )

 দোটানা
 ফেরার সময় ওরা ঘিরে ধরে। ছসাতজন। প্রত্যেকেরই 
রয়েছে কিছি-নাকিছু হাতে। আসার সময় জানতুম আজ
গোলমাল হবে তাই তৈরি হয়েই এসেছি। তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাবো না সেটা ঠিক করা আছে।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, "পেরেম করতে এয়েচো
এপাড়ায় ! কেন ? নিজের বাড়িতে মাগ নেই নাকি"।

দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি। তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে সেটা হাত দিয়ে টের পাই।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি। মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি--
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় ছিদাম লেখা একপিঠে মাকালী ওপিঠে।
জটলা ছিৎরে যায়। চাকু-দেবতার নামে কত গুণ আছে
সকলে জানে না।মানব কেন অমন কুচুটে?
প্রেমিকের জন্যে কোনো ভালোবাসা নেই ? এই যে ছসাতজন
মনের স্বামীত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটি ঝলকে !
( ২৯ আষাঢ় ১৩৯২ )

মুরগির রোস্ট

পালক ফুলিয়ে ক্রোধে লড়ো মুর্গা, চাকুমালিককে খুশ করো
হুলেতে পরাগ মেখে ঝাপটাও ডানা
বলেওছি: দুহাত মুচড়ে নতজানু করে রাখো
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মাদুর গুটিয়ে নেমে এসো ছাদ থেকে
বুটজুতো -- রাইফেল -- ঘুরন্ত বুলেট -- চিৎকার

বাড়ি নিয়ে যাও বলে কেঁদে ওঠে পাশের হাজতে বন্ধ বৃদ্ধ কয়েদি
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও যেতে দাও বাড়ি যেতে দাও
ডিমের ওপরে বসে সিংহাসনে ঝিমোয় ডাহুক
অন্ধকারে গলা টিপে ধরো
লড়ো মুর্গা, মরো লড়ে, গর্জাও গুঙ্গার দলে ঢুকে

জিভেতে কাঁচের ফুলকি -- নাচাচ্ছি বুকের পেশি
মাছের কানকো খুলে জলেতে কুয়াশা মিশিয়েছি
কড়ে আঙুলের টুকরো মোড়া ছিল গোলাপি কাগজে
দুহাতে দুচোখ ঢেকে কে কাঁদে হাউ-হাউ করে জেলখানায়
                    নারী না পুরুষ আমি বুঝতে পারি না
এ নাও চোখের পাতা -- ফুঁ দাও বাঁহাতে রেখে
শিশিরে ফণার পাঞ্জা খোলো
             মেয়েলি হিসির শব্দে তলপেট কাঁপে জাতগোখরোর
রক্ত গড়ালে নাকে তুলো গুঁজে শ্মশানে পাঠাও
রাস্তায় পড়ে থাকবে চটিজুতো ভাঙাইঁট ঠ্যাঙ টেনে ছেঁড়া পাতলুন

ঝড়ের সমুদ্র থেকে যে-ঢেউ খাবলে তুলে মেখেছি দুপায়ে
সে-নব বর্ণমালা থেকে আজ হরফ এনেছি
(১২ চৈত্র ১৩৯২)

আরেকবার উহুরু


কালো কাপড়ের খোল মুখেতে পরানো, দুই হাত
পিছমোড়া করে বাঁধা, দাঁড়িয়ে রয়েছি পাটাতনে,
জল্লাদের ঘামের তিতকুটে গন্ধে ভোরের বাতাস থম--
সময় গুনছে কারা ? ডাক্তার পুলিশ জজ ওয়ার্ডেন ? নাকি কেউই গোনে না !

আচমকা নেমে যাব ঝুপ শব্দে যেখানে ঘোলাটে অন্ধকারে
পোষা হয় ঘামলোনা নোংরা ইতিহাস; 
কাঁপতে থাকবে দড়ি, প্রথমে খুবই ঘন ঘন, 
দুর্বল ঝাঁকুনি, তারপর স্হির, বোবা চিৎকারে
ওভাবে যেখানে কবি খুনি নেমে গেছে বহুবার
আমিতো উঠেছি আজ সেইখান থেকে জ্যান্ত হয়ে

এই একমাত্র ওঠা! এছাড়া উথ্থান নেই শব্দদানবের
যাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকে বিধ্বস্ত ভূগোল

মরার জন্যে যারা জন্ময় আমি সেই ধর্মবংশ
বাঁচিয়ে রাখব বলে বারবার ঝুলি না ফাঁসিতে।
(১৯ আষাঢ় ১৩৯২)


লালসেলাম হায়

মুখের গহ্বরে এক জান্তব গোঙানি ডাক চলাফেরা করে
জেলহাজতের ভিড়ে ত্রিকালজ্ঞ ভিড় দেখে চমকে উঠি
এরা কারা হাতকড়া পরে ঠাঠা হাসে সারাদিন
বাইরে যারা রয়ে গেল ঝুঁকিয়ে দাঁতাল মাথা 
তারাই বা কারা ?
জল্লাদের ছেড়ে দেয়া প্রশ্বাস বুক ভরে টানে!

চাই না এসব ধন্দ
মশারি খাটিয়ে বিছানায় সাপ নারীর বদলে

নৌকোর গোলুই থেকে ছুরি হাতে জ্যোৎস্নায়
বুকের ওপরে বসবে লুঙি-পরা রোমশ সারেঙ
নাসারন্ধ্র থেকে বন্দুকের ধোঁয়া
'বল শালা শকুন্তলার আংটি কোন মাছে আছে'

জানি তবু বলতে পারি না
মুখের ভেতর আংটি জিভের তলায় আমি লুকিয়ে রেখেছি।
(২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২)

আলো 

আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেতে ধুলোপড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুনি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দুতিনবার
কষ বেয়ে রক্ত গড়াতে থাকে টেরপাই

আবার তীব্র আলো মুহূর্তে জ্বলে উঠে নিভে যায় 
গরম লোহার রড খালি পিঠে মাংস ছেঁচে তোলে
আমাকে লক্ষ করে চারিদিক থেকে আলো ঝলসে ওঠে ফের
আপনা থেকেই চোখ কুঁচকে যায় দেখতে পাই না কাউকে
একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্যে নিজেকে তৈরি করে নিই।
( ২ মাঘ ১৩৯১ )

প্রত্যক্ষ

সম্বিত ফিরে পাচ্ছি ক্রমে
হাত-পা ও মুখ বাঁধা পড়ে আছি রেলের লাইনে
চারিদিক খাঁ-খাঁ
শিশিরে কাপড়-জামা ভিজে গেছে
একটানা ঝিঁঝির আওয়াজ
ঠাণ্ডা নক্ষত্রে ভরা গেঁও অন্ধকার
মুখের ভেতর তুলো ঠোসা তাই চিৎকার করতে পারছি না
প্রচণ্ড মারের চোটে পায়ের বুকের হাড় ভেঙে গেছে
                                        নিজেকে নড়ানো যাচ্ছে না
পিঠে ফুটছে শক্ত পাথর---
কী সুন্দর এ-পৃথিবী কোথাও অশান্তি নেই সবকিছু দিব্বি চুপচাপ
অন্ধকার ফুঁড়ে বেগে আলোকবিন্দু এক এগিয়ে আসছে এই রেলপথ ধরে।
( ২২ পৌষ ১৩৯২ )

অস্তিত্ব

ভোর রাতে দরোজায় গ্রেপ্তারের টোকা পড়ে
একটা কয়েদি মারা গেছে তার স্হান নিতে হবে

জামাটা গলিয়ে নেবো ? দুমুঠো কি খেয়ে নেবো ?
পিছনের ছাদ দিয়ে পালাবো কি ?

কপাট ভাঙার শব্দে খসে পড়ে চুনবালি
মুখেতে রুমাল বেঁধে কিছু লোক ঘরে ঢুকে পড়ে
'ট্যারাচোখ ফরসা চেহারা লোকটা কি যেন কী নাম
কোন ঘরে লুকিয়ে রয়েছে নয়তো আপনাকেই
আমাদের সঙ্গে যেতে হবে'

ভয়েতে গলার স্বর বুজে আসে; আজ্ঞে স্যার কালকে সকালে
পাড়ার লোকেরা তাকে কুপিয়ে মেরেছে।
( ১১ ফাল্গুন ১৩৯১ )

দুঃখ 


মুখের সেলাই খুলে ফোঁপাতে চেষ্টা করি
পেঙুইন পাখালির দুধসাদা বুকে মুখ রেখে মনে হয় কেঁদে ফেলি
চারিপাশে বোবাকালা খেয়াল গাইয়েরা বসে নুলো হাত নাড়ে
ও-সঙ্গীত বন্ধ করো সজারুর কাঁটা খসে যাবে
গোরক্ত শরীরে মেখে খুনি পিঁপড়ের ঝাঁকে শয়ন করেছি
এখানে চামড়ার টাকা ভাঙাতে দেব না

সৈন্ধব লবণে তৈরি হৃৎপিণ্ড নিয়ে তুমি দরোজা আগলে রাখো কেন
ঝুলে থাকো আমরণ চামচিকেদের সাথে
বুড়ো আঙুলের ছাপ পৃথিবীতে রেখে
                           তৌজি মৌজা সব বিলি করে দেব
একবস্ত্রে বহুবার রাকস্যাক পিঠে রেখে সভ্যতা ছেড়েছি
ক্লিওপেট্রার মসীলিপ্ত যোনি টানতে পারেনি
বারংবার চমকেছে গা ঘেঁষে বিদ্যুতলতা
চাবুকের দাগ দেখা যাবে বলে পোশাক খুলি না
( ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২ )

বজ্রমূর্খের তর্ক

আজকে শুক্কুরবার। মাইনে পেয়েচি।বোধায় শরতকালের পুন্নিমে।
পাতলা মেঘের মধ্যে জ্যোসনা খেলছে। মাঝরাত। রাস্তাঘাট ফাঁকা।
সামান্য টেনিচি তাড়ি। গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ।
কোথাও কিচ্ছু নেই হটাৎ কুচকুচে কালো নেড়িকুকুরের দল
ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। তাড়া করে। বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি।
বুঝতে পারিনি আগে। রাজপথে এসে হুঁশ হয়।
মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে। কী করে ফিরব বাড়ি?
কেউ তো বিশ্বাস করবে না। ভাববে খেলেচে রেস,
গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে।
বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। রেসও খেলি না কতকাল।
অন্য স্ত্রীলোকের খোলা বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
ভুলে গেচি। জানি না বিশ্বস করে না কেউ কেন!
আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করিচি বুঝি।
যা কইনি সেকথা বলিচি। তাহলে এ-পুন্নিমের মানে?
কেন এই মাইনে পাওয়া? কেন গান? কেন তাড়ি?

আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে। নির্ঘাত কুকুরগুলো
গন্ধ শুঁকে টের পাবে। ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে।
যা হবার হয়ে যাক। আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার।
( ২৭ আষাঢ় ১৩৯২)