মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

হাততালি -- একটি পোস্টমডার্ন কবিতা

( শ্রীমতী মীরা বেনুগোপালনের জন্য, যিনি প্রথম পরিচয়ের দিনই আমায় বলেছিলেন যে তাঁর ইউটেরাস নেই । তাঁর জন্যে লেখা এটি একটি প্রেমের কবিতা। প্রেমের কবিতাকে, তাঁরই সাহায্যে, আমি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদল-আদরা দেবার প্রয়াস করেছি। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলুম পুস্তিকাটি। দুর্ভাগ্যবশত কবিতা-পুস্তিকাটির প্রডাকশান ভালো হয়নি।তিনি তবু পুস্তিকাটি আনন্দে গ্রহণ করেছিলেন, যেমন আমাকে। )

তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
পইপই বারণের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
দগদগে রোদে
চন্দন-রক্তের পাথর-পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
হাহ
রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
হরতালের দরুণ ক্রুশকাঠ থেকে নামতে পারেননি হাততালি
চোখে জলসুদ্দু হেসেছে শিশুরা


একথোকা অন্ধকারে জোর করে দেখানো স্বপ্নে
যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছিল লালশালু নৌকোর হাততালি
না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে
গরম আলকাৎরায় ফোটা ফরসা রজনীগন্ধা
যখন নরুন-খোদাই বাতাসে
নিকেল চকচকে বিচিবীজ
কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি
ঘাসফুলে না-ফোঁপানো ফড়িং-পুরুষ
বারবাডোজ-পেশির ব্রোঞ্জপুরুষরা
জরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর পশুপশম নাভিতে


চিরুনিধার বৃষ্টিতে
ভুরু কোঁচকানো ঢেউয়ে শুয়ে
জলকে থাপড়েছে ডিজেল-চাদর ছায়া
সমস্ত ডানা সরিয়ে ফেলা হয়েছে আকাশ থেকে
হরিবোল দিতে-দিতে সাংবাদিকের সদ্যছাপা সকাল
চাবির ঘোলাটে ফুটোয় যাবজ্জীবন কয়েদির চোখ
বাইরে
হেমন্তের ঢেঁকিতে গোলাপ-গোড়ালি
লালুং রমণী


ঘামসুগন্ধে বিহ্বল প্রতিধ্বনি ফেরত চেঁচাতে ভুলে যায়
তারপর
অপারেশন বুলশিট
মুখে ঘা
শহিদ চবুতরায় অর্ধনমিত লিঙ্গে যুবাবিপ্লবীর শীৎকার পেঁয়াজবাটায় ভেজা আমিষ হৃদয়
চোখে কালি হাসনুহানা
জলে ভিজে পদ্মফুলের নিউমোনিয়া
হুঁকোটানা বুড়ো রেলগাড়িতে মেঘের চেষ্টাকৃত গর্জন
আর সোনার মাকড়সার জালে ঢাকা বিদ্যুৎ
হোঁতকা মরদকে সবুজ পিঠ থেকে নামিয়ে দিয়েছে ব্যাঙযুবতী


ব্যাবিলনের শাদা নরকহুরি
উত্তরমুখো নকশিমেঘের ওষুধ বড়ি গিলিয়েছে
রেড়িপ্রদীপে ঝুঁকে ঘুরঘুরে শুঁটি পোকা
এলোচুলে ঢাকা উল্কামুখ রাজকন্যের মুকুট থেকে গানের টুকরো
পায়ে রক্তমাখা রাজহাঁস
যখন-তখন চেয়েছে বাড়িফেরত সৈন্যের বসন্তকাল
সাজিয়েছে খেলাচ্ছলে মারা চরমযুবার মা-বাপের সবুজকাঁথা ধানখেত
তুঁতেরঙা কুয়াশা এগিয়েছে সিংহ চামড়া শিকারির গোপন ঘাসপথবিয়াহযোগ্য ঘুড়সওয়ার হাততালি
হেই হো


কিছুটা অপরিচিত থাকার কষ্টে 
যে-বাগান সুপুরিগাছকে কড়ে আঙুলে দাঁড় করিয়ে আজীবন
দূরপাল্লার ঝড়ে
ল্যাম্পপোস্টের নীচে
বৃষ্টি মুড়িদিয়ে
সেই ভাঙচুর চেহারাই তাঁর আঙ্গিক
যে-আদল খুঁজেছে শরীর এলিয়ে দেয়া ঢেউ
কথকনাচে বাঁধা ব্রহ্মাণ্ড
মন্দিরের চোরাকুঠুরিতে মুখবাঁধা
হাততালি


আগুন যখন ধোঁয়া থেকে আলাদা হচ্ছে
যেটুকু সময়ে
আলজিভ
দুই হৃৎস্পন্দনের মাঝে তেতো হয়ে ওঠে
জলপথে এসে আক্রমণ করেছে জ্বরবিদ্রোহী
গাছে-গাছে ঝড়কালীন পলাশের সখ্যতা
ঠিক যেন চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎহীন
শেষ হাওয়ায়
পটকা ফাটিয়েছে রাংতাপাড় মেঘ
যেন এক্ষুনি এসে পড়ল বলে হাততালি


রাতভর ছড়ানো হাততালি সকালে এককোণে ঝেঁটিয়েছে ঝাড়ুদার
আঘাতহীন ভালোবাসায়
থলেতে পুরেছে অসুস্হ গঙ্গানদীকে
এক বা তিনরঙা পতপতে রামধনু
কবরে পাওয়া গেছে ভাতখাবার কাঁসি
অত্যাচারিতের কাতরানিতে পড়েছে হাড়ের খিলান
কেউ সুখী নয়
কেমন আছো জানতে চাইলে বলেছে
ভালো
পাকের পর পাক কোমর থেকে কাঁটাতার খুলে দিয়েছে


নষ্টের শপথ আওড়ানো শেষে
শহরগ্রামে রোঁদে বেরিয়েছে মড়াসংগ্রহকারী
কষ্ট হলে কাঁদতে পারার আশীর্বাদ চেয়েছে নগরবাসী
ওদিকে হাততালিবাদক
ভগ্নস্বাস্হ্য আকাশপাখিদের গান শুধরে দিতে চেয়েছে
তারা দপদপে অন্ধকারে
বালিশ-জড়ানো বর্ষায়
পালামৌ জেহানাবাদ রোহতাসে কাদাপেছল মাগুরের আঁশটে হাঁপানি
শামুক-থুতনি বুড়ির চোখের পাতায় ধূসর সোরাগন্ধক


আধপচা হুগলি নদীর ডাগরচোখ পারশের গান শুনতে
কেউটে যুবতীর শরীর থেকে খসে পড়েছিল শীতের মিহিন আদল
আচমকা সজারু
বিয়ের লাল বেনারসিতে শিমুল
এদিকপানে মুখ করে দাঁড়িয়েছে ছোকরা সূর্যমুখী
গরম তেলে লাল দুহাত উড়িয়ে স্বাস্হ্যবতী কাঁকড়া
ভাতের হাঁড়িতে নেচেছে সফেদ-মসলিন নরম অপ্সরা
তখন অন্ধকারে কেঁদে নিয়ে আলোয় হেসেছে হাততালি
হাসপাতালের বিছানায় লোহার শেকলে বাঁধা শুনেছে
টেবিল ঘড়িতে সারারাত গ্রেপ্তারের ঠকঠক ঠকঠক ঠকঠক


( মুম্বাই ১২ মাঘ ১৩৯৫ )
পোস্টমডার্ন কবিতার জনক ফেদেরিকো দ্য ওনিস



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন