মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

শনিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

প্রেমের কবিতা

  ( এই কবিতাগুলো হাংরি আন্দোলনের কবিতা নয়। হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার বহু পরে এগুলো লখনউতে থাকতে লেখা )


দালাল
এ কী কুলনারী তুমি জাহাজঘাটায় দেহ বেচতে এসেছো
        লুঙিপরা পানখোর দালাল রাখোনি
সাদাপোশাকের কবি শরীর ঝাঁঝরা করে দেবে
শাঁখা-নোয়া খুলে তারা দু'হাত হিঁচড়ে টেনে তুলবে লরিতে
লকাপে ল্যাংটো মাঝরাত---সে সময়ে গেয়ো তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত

ছিহ কুলখুকি তুমি সবায়ের আদর কুড়োও
যার-তার সাথে গিয়ে যেখানে-সেখানে শুয়ে পড়ো
চারিদিকে কটাচোখো ধ্রুপদি জোচ্চোর সব নজর রাখছে মনে রেখো

আমি তো স্ট্রেচারবাহী কিছুই করতে পারব না
হয়তো টিফিন-বাক্সে এনে দেব রুটি আর আলুজিরে ভাজা
    গান শোনাবার মাঝে ঝুঁকে ঝুঁকে পয়সা কুড়োবে
ভোর হলে গঙ্গার পাড়ে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বমি কোরো
    হাসপাতালেতে পাবে বেডপ্যান গ্লুকোজ বোতলে জল
তেলছিটে বিছানায় পাশে শোয়া ঘুমন্ত কুকুর।
 ( ১৭ অঘ্রাণ ১৩৯২ )

শুদ্ধ চেতনার রহস্য
ঠিক আছে, লাফাও
অ্যালুমিনিয়াম-ফ্রেম কাচের জানালা খুলে কুড়ি তলা থেকে
বাতাসে ঝাঁপাও তুমি টাঙাইল আঁচল উড়িয়ে
শূন্যে ভাসবে কালো ঢাল এলোকেশ
দুপায়ে অচেনা নাচে পৃথিবীর রঙিন মাটিতে
নেমে এসো তুমি
তখন খামচে দেখো হাওয়ার শরীর কীরকম
খেলবে তোমাকে নিয়ে ওলোট-পালোট
আমার পায়ের কাছে পড়ে তুমি ছত্রখান হও
খণ্ড-বিখণ্ড হাড় থ্যাঁতা-মাংস নাড়িভুড়ি সব একাকার
ঠোঁট যোনি উরু নাভি পাছা স্তন আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে
সৌন্দর্য-বিমূর্ত ক্বাথে মাছির খোরাক হবে তুমি
সব জড়ো করে তবু তুমি নও
তুমি সেসময়ে রৌদ্রে ভাসমান
বুঝেছিলে মিথ্যে এই অধঃপতন। 
২১ আষাঢ় ১৩৯২ 

দোটানা
ফেরার সময় ওরা ঘিরে ধরে। ছ'সাতজন। প্রত্যেকরই
রয়েছে কিছু-নাকিছু হাতে। আসার সময় জানতুম আজ
গোলমাল হবে তাই তৈরি হয়েই এসেছি। তবু প্রথমেই
নিজের তরফ থেকে হাত ওঠাবব না, সেটা ঠিক করা আছে।
জামার কলার ধরে একজন খিস্তি করে, 'পরেম করতধে এয়েচো
এপাড়ায়! কেন? নিজের বাড়িতে মাগ নেই নাকি।'

দাঁতে দাঁত দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখি। তখনই চোয়ালে ঘুষি
রক্ত টেনে বের করে যেটা হাত দিয়ে টের পাই।
এক ঝটকায় ছাড়িয়েই বসে পড়ি। মোজার ভেতর থেকে
চকিতে বেরিয়ে আসে নতুন প্রজন্মের ক্ষিপ্র চিৎপুরি---
হ্যালোজেন-মাখা অন্ধকারে ঝলসে ওঠে স্টেনলেস চাকু
ফলায় 'ছিদাম' লেখা একপিঠে 'মাকালী' ওপিঠে।
জটলা ছিৎরে যায়। চাকু০-দেবতার নামে কতগুণ আছে
সকলে জানে না। মানব কেন অমন কুচুটে?
প্রেমিকের জন্য কোনো ভালোবাসা নেই? এই যে ছ'সাতজন
মনের স্বামিত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে ঘিরে ধরেছিল
কেমন গুটিয়ে গেল চাউনির একটু ঝলকে !
২৯ আষাঢ় ১৩৯২ 

ছি কলকাতা
থাকো তুমি তোমার ওই হিজড়েদের নিয়ে
তুমি তো তাদের আয়া স্বপ্নে যারা বর্ষাকালে বিছানায় মোতে
ইজের বদল করো ঠ্যাঙ তুলে
ফড়েরা পেচ্ছাপ করবে বলে তুমি দেয়ালে মহৎকথা লেখো
তোমার ব্যাপারে আর থাকতে চাই না আমি
তোমাকে চুম্বন করলে মৃত্যুর পরেও জানি টকে থাকবে মুখ
যেও গিয়ে কেরানি বিপ্লব করো বি-বা-দী পাড়ায়
তোমার খুলির ফাঁকে কেবলই পয়সা ফেলতা ডাকো তুমি

আমি তো মনুষ্যতর দানো
অঙ্গপ্রত্যঙ্গে স্হিতিস্হাপকতা নিয়ে জাপটে পিষে দিতে পারি
পায়েতে পাথর বেঁধে ফেলে দিতে পারি এঁদো পুকুরে-ডোবায়
তোমার ঘরেতে ঢুকলে দালালের টোকা পড়বে দরোজায়
"জলদি সারো আরও দু'জন বায়না দিয়েছে।"
১৭ বৈশাখ ১৩৯২

বিজ্ঞানসম্মত কীর্তি
ফ্যান টাঙাবার ওই খালি হুক থেকে
কন্ঠে নাইলন দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ো
কপাট ভেজিয়ে দরোজার চুপিসাড়ে
উঁচুতানে রেডিও চালিয়ে তাড়াতাড়ি
শাড়িশায়া জামা খুলে টুলের ওপরে
দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস-রশি পরে নিয়ো
সারারাত অন্ধকারে একা ঝুলে থেকো
চোখ ঠিকরিয়ে জিভ বাইরে বেরোনো
দু'পাশে বেহুঁশ দুই বাহু আর স্তন
জমাট ষোড়শী শূন্য পায়ের তলায়
পৃথিবীর ধরা-ছোঁয়া ছাড়িয়ে যেখানে
বহু পুরুষের ঠোঁটে আদর খেয়েছো
সে-শরীর ছুঁতে ভয় পাবে তারা আজ

দোলো লাশ নামাবার জন্যে আছি আমি। 
১৯ শ্রাবণ ১৩৯২

শিল্পোন্নয়ন
এ খি তুমি এইখানে পাগলাগারদে
পায়েতে শেকলবাঁধা নেয়ারের খাতে
উদোম উলঙ্গ শুয়ে আছো চুলে জট
নোংরা নখ বেড়ে গেছে দু'চোখে ঢুলুনি
সারাঘর বমি মুত পায়খানা ভরা
ভাতমাখা এনামেল থালা এক কোণে
শরীর ধোওনি জলে নেমে কতদিন
চেনাই যায় না এক কালে পাঁচতারা
হোটেলে নেচেছো নাভি নিতম্ব কাঁপিয়ে

আরেকবার সুস্হ হও শুভ্রা রায়
নাচব সকলে তুর্কি গাঁজা ভাঙ টেনে
হাড়িয়া মহুল খেয়ে ফিরিঙি আদলে
উঠে এসো সুর্মা চোখে লুপুঙগুটুতে
বেবাক দুনিয়া যায় জাহান্নমে যাক।   
২১ শ্রাবণ ১৩৯২

 বাজারিনী
বিশ বছরের পর এলে তুমি। তোমার আদুরে ভাষা পালটে গিয়েছে
বারবার। জানি তুমি শুভ্রা রায় নও। ওরকমভাবে একঠায়ে
সারাদিন মাথা নিচু করে বসে থাকো। আমার চুলেতে পাক
ধরে গেছে। শেখাও তোমার ভাষা এইবার। দেখি কীরকম
ঠোঁট নড়ে নাভি খিলখিল কেঁপে হেসে কুটি হয়।যুবকেরা
ঘিরে থাকে বহুক্ষণ তোমায় আড়াল করে। কিসের কথা যে এধ হয়
কিছুই বুঝি না। অন্তত কুড়ি বছরের ছোট হবে তুমি।
জানি না কাদের জন্যে অন্ন আনাজ সংগ্রহে আজ এলোচুলে
নেমেছ বাজারে। লুবাতাসে রোদেপুড়ে কালো হয়ে যাবে শেষে।
তুমুল বৃষ্টির মাঝে কীভাবে বাসায় ফেরো? ওই যুবকেরা
ছাতা ধরে মাথার ওপরে? বাড়ি ফিরে ভিজে চুল বোধায় শোকাও একা।
সকালে কি রান্না করে আসো? সেগুলোই রাতে খাও?
শরীর খারাপ হলে কারা দ্যাখে ? কে কাপড় কাচে?

আমার সন্ত্রাসবাজি রাহাজানি লুটমারথেকে জানি তোমার দুনিয়া
আলাদা একদম। তোমাকে নিজের নাম বলতে পারি না আমি।
যদি ঘেন্না করো, জেনে যাও কী-কী করি, ভয় পাও।
কতদিন ইচ্ছে হয় সামান্য ইশারা করে আমার দলের লোকেদের
তোমাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে নিতে বলি।
দাঁড়াবে আমার সামনে এসে তুমি। বলবে, 'আমাকে যেতে দিন'।
২৮ আষাঢ় ১৩৯২ 

পরবর্তী সর্বনাশ
পাহাড়ের বাঁকে ট্রেন দেখা গেছে যাও
এই বেলা ঘুমে অচেতন গৃহস্হালি
ফেলে ছোটো মাথা পেতে দিতে রেলপথে
এর পর রাতে আর কোনো ট্রেন নেই
পিষে কেটে ছ'টুকরো হয়ে যাও তুমি
শাঁখা-পলা গুঁড়ো হয়ে মিশুক মাটিতে
তলপেটে রাখা ভ্রুণ নিসর্গে ফিরুক
ট্রেনের পয়ার ছন্দে নিজেকে ভুলিয়ে
তোলপাড় করে দাও সুখের সংসার
ভয় দুঃখ শোক গ্লানি দিয়ে বন্ধ করো
অমল আনন্দ শেষ হোক ভাঙা ঘুমে
দধ'হাত বাড়িয়ে সারারাত রেলপথ
শিশির উপেক্ষা করে তোমার শরীর
পাবে বলে ঠায় জেগে আছে সন্ধে থেকে ।
২০ শ্রাবণ ১৩৯২ 

ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
শেষরাতে পাশ ধেকে কখন উঠেছ
চুপচাপ আলমারি ভেঙে কী অ্যাসিড
ঢকঢক করে গিলে মরছ এখন
আলজিভ খসে গেছে দু'গালে কোটর
মাড়িদাঁত দেখা যায় কষেতে বইছে
গাঢ় ফেনা হাঁটুতে ধরেছে খিঁচ ব্যথা
চুল আলুথালু বেনারসি শাড়ি সায়া
রক্তে জবজবে মুঠোতে কাজললতা
শোলার মুকুট রক্ত-মাখা একপাশে
কী করে করেছ সহ্য জানতে পারিনি
শুনতে পাইনি কোনো চাপা চিৎকার
তবে কেন সায় দিয়েছিলে ঘাড় নেড়ে
আমি চাই যে করেই হোক বেঁচে ওঠো
সমগ্র জীবন থাকো কথাহীন হয়ে
২২ শ্রাবণ ১৩৯১ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন