মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

সোমবার, ৪ মে, ২০২০

মহীলতার বার্ধক্য - একটি পোস্টমডার্ন কবিতা

মহীলতার বার্ধক্য - একটি পোস্টমডার্ন কবিতা
উৎসর্গ : রুদ্র কিংশুক
 
এক
যে-বয়সে আঁজলায় জলস্তম্ভ তুলে ধরতুম, শিশুরা উপুড় হয়ে ভেসে যেত স্বচ্ছ জলে ঝুলতে-থাকা গোলাপি লেংটু, জন্মেই নিজের নামের জন্যে ডুকরে উঠেছিল, মুঠোয় ধরে-রাখা পুরোনো রোদ্দুর নিয়ে ভেসে চলেছে, বিদ্যুতের চমকে ধুয়ে যাচ্ছে আগাপাশতলা, জোনাকি শহরের হীরকিত তাঁবা-মাস্তুল, সবুজ বাতাসের সঙ্গে দৌড়ুতে-থাকা নধর ঘাসের হুল্লোড়, এক কোণে খরা ও বানভাসির গানহীন জাঁতাপাথর, বুববুদের ঝাঁকে বয়স বাড়তে থাকে সেসব মৃত শিশুর, কথা আর প্রাণ টেনে বের করা হয়েছিল, ফিনকি দিয়ে ওঠা চিৎকার, অনাদরে ফুটে-ওঠা নারীখোঁপার জুঁহি, যে-নারীরা সঙ্গমের একটু আগেছিটকিনিতে হাত রেখে আপাত-গম্ভীর, ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে আর ভীমরুল-চাকে ঢুকে গেছে ঘুষি, তারপর হাতে চেটো ঝেড়ে ওড়ায় রুপোর বালিকণা, সেই গানপাগল যোনিসুগন্ধের দেশ, আঁশটে টালি-চালের নিচু ছাদ, জালিকাটা গেঞ্জির তলায় লুকোনো অজর অনড় বার্ধক্যের জন্য বাঁধা গান, শ্মশান-পুরুতের ছু-মন্তর, দুই তীর বেয়ে পেছিয়ে চলেছে কয়লার ধোঁয়া বেচতে-থাকা ভোর-শহরের চা-দোকান ও আধোঘুম ছোকরা, কৃষকের নিজস্ব ধানশিষ !
দুই
যে-বয়সে দুশো বছরের পুরোনো আঘাত থেকে আমাদের রক্ত ঝরে পড়েছে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসেছে মিছিলের আওয়াজ, সেই মিছিল যিনি আমাদের কপালে ভাঁজ এঁকে দেন, মেঘের পাদানিতে দাঁড় করিয়ে চোখে মূর্ছা কপালে হিমঘাম আনেন, আসামির কাছে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন কলম-হারানো বিচারক আর জলেতে জাল পড়ার শব্দ চিলকে উঠেছে চারাপোনা, পাশেই নুন-মাখানো বালিয়াড়ি, বর্ষার নদীর জন্য আপদকালীন পাথরপথ কাৎরে বেরোনো নুড়ি-পাথর তখন আমরা রাজরাস্তায় পিষে-মরা পিঁপড়ের কথা খুব ভাবতুম কেননা হাজার বছর তো পাহাড়ও হয়ে যাবে প্রমাণ মাপের, শুনতুম স্বীকারোক্তির বেধড়ক, লক্কড়ের দরাদরি নিয়ে মুটকো ঘৃতকুমারের বচসা, শরীরে কাঠবিড়ালির ফুর্তি কিন্তু অন্ধকারের নিজের অপরাধবোধ নেই তা জানতুম, নড়ে উঠতেন সংসদের শেষ কচ্ছপটি যারা সন্তানের চামড়া খুলে ভুষি ভরে দিয়েছিল, তাদের দীর্ঘমেয়াদি সুদে পাওয়া সেপটিক তুলো ও কিমামজর্দা, চোখের পাতা ঢাকা পড়ে যায় আর এখন তো ধানবীজের জানালার কপাট যেদিকে খোলে বাতাসের আকৃতি দেখে মোমের গলে যাওয়া টের পাই, মায়ানারীদের বিছানায় উদোম অতিথিরা, নাচের গোড়ালি থিরকিয়ে আঘাতের ইতিহাস লেখেন !
তিন
যে-বয়সে বুড়ো বলে কান্নার অতীত হয়ে গেছি, ছেঁকে ধরেছে মাইলপাথর-পোঁতা পৃথিবী, ডানায় চাকা-লাগানো আফরিদি যুবতীদল, লেজারবহিতে জমানো দশমিক,, মনে পড়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষায় কাঁদতে-থাকা অর্জুন, বীর ও বোকার পচা মাংসের মাঝে হেসে-খেলে বড়ো-হওয়া শকুনযুবতী, পাগলামিতে চিকন চোখের পাতা কান্নাকে সংগীতময় করে তুলেছে, যেন অন্ধকারকে গান শোনাতে-থাকা ভিতু গাঁওপথিক, উকুনমাথা দেবদূত, ঝড়ের পাক থেকে খুলে বার করে আনে নারীকন্ঠ, টাট্টু গাধায় চেপে ক্ষমতার বন্দনায় গড়ে-ওঠা মুদ্রাস্ফীতি এনেছে থালায় শোয়া সুকুমার মোরগদেহ, মাঝে-মাঝে হাঁপিয়ে-পড়া বাঁশির জিরেন, সুগন্ধ তখন যৌনতাকে দামি করে তুলত, ঠিক যেমন শনিচরির ছোঁয়াচ-লাগা বরফকুচি আর ইঁদুর গর্তের গুমোট গ্রীষ্মে, শব্দের ভেতর দিয়ে আমি তাদের এগিয়ে যেতে দিয়েছি মড়াপোড়ার আধভেজা আগুনের দিকে, মান্ধাতার জংধরা দোনলার গলা-খাঁকারিতে নিজেদের আড়াল করেছে !
চার
যে-বয়সে কোমর পর্যন্ত জমে-ওঠা জঞ্জালের মাঝে দাঁড়িয়ে সানথাল সংগীত শিক্ষকের কোলঢোলোক বাজাতুম, হাতে পেরেকের ফুটো থাকায় সমুদ্র ধরে রাখা যেত না, গোটানো কুষ্ঠিকাগজ খুলে বেরিয়ে এসেছে রাতবিরেতের বালিয়াড়ির ছমছমে শিস ও সবুজ চাঁদ, পুঁজিপ্রেতের আলিঙ্গনে দোমড়ানো কাঠকঠোর আত্মা, ন্যাকড়াকানি পরা শিশুদের সাবান মাখার বিজ্ঞাপন, ভারবাহী আমলার চোথাখাতা, তখন ওব্দি অমরত্ব কাউকে ফুসলিয়ে মমি করেনি, খেতে পেতুম সবাই ল্যাংটো মেমবালিকার মতন বিশাল মাছ আর পাওয়া যেত ড্রাগনফড়িঙের সবুজ নমস্কার, নারীর পারাতরল তোয়াজ আর মৌপোকার অবিনশ্বর আঙ্গিকের নাচ, শীত ছড়াত মৃত্যুর গুজব আর স্কুলবালকের পাঠ্যপুস্তকে হরণ-করা প্রজাপতি-তরুণী যেন খাজনা বিয়োগে আতুর হেমন্ত !
পাঁচ
যে-বয়সে বুকে মেডেল ঝোলানো প্রবাদপুরুষ ও পাঁচকোণা চোয়ালমুখো মাস্তানরা ঝড়ের গাছালিকে উৎসাহিত করেছে, রংরঙিন সূর্য, চড়ুইভাতির যুবতীরা ছল করে ডেকেছে সঙ্গমে, রাস্তার মিছিলে গম্ভীর গান্ধিপাথর, পেকে ওঠার ওজনে হলুদ গোলাপজাম, কোনো এক যুবতীর উন্মাদনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছি, সাক্ষ্যমুহূর্তে দেখে-ফেলা খুনি, মাঝরাতের আলো আর বই নিয়ে ছেঁকে তোলা তিনশো বছরের বাসিজ্ঞান, কপাটে আঁচড়ের দাগ, কান্না বা কর্কটরোগে হৃদয় আধখাওয়া হয়নি, যদিও ডিজেল টেনে মাতাল পোঁদ-উলটানো ট্রাকগুলো পড়ে থাকত, দুই কীটপোকার কথোপকথনের মাঝে আমি হতবোকা, বিশ্বযুদ্ধে গেরুয়াসাধুর একাকীত্ব যেন নরক থেকে দাড়ি-না-কামিয়ে ফেরা দ্রোহী, আলো নিভলেই তলপেট ভরে উঠত দেবদূতে আর বিদ্যুতের ছাঁচে ঢালাই করে নিতিম শব্দ, ধানখেতের ওপর দিয়ে বার্তাহীন তামার কিলোমাইল চলেই চলেছে, তখন শেষ শুক্রপতঙ্গ ভাসেনি হিসিতে !
ছয়
যে বয়সে ধ্বংসাবশেষে আগুন খুঁজেছে জলপাইপ, হাজার বছরের পাথুরে যোনির জলশীতল যাদুঘরের ছায়াগন্ধ থেকে বেরিয়ে পড়েছি বাইরে, বাঁ-হাতে মুছেচি কপালের তাম্রলিপি, সূর্যকে সমুদ্র থেকে তুলে জল ঝেড়ে রেখে দিয়েছি আগেকার জায়গায়
১২ - ১৪ নভেম্বর ১৯৯৪
ছবিতে থাকতে পারে: 1 জন
 
 
 
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন