মলয় রায়চৌধুরী

মলয় রায়চৌধুরী

শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২০

রক্তবীজ

 

রক্তবীজ

মলয় রায়চৌধুরী

সত্তর বছর ধরে  আমাকে ডেকে জানতে চাও কাকে অশ্লীলতা বলা হয় ? 

বলি, উসকানিতে উত্তেজিত মগজের ভেতরে রক্তবীজ পুঁতেছো বলেই

আমরা হিংসার রাজনৈতিক প্রণোদনা লক্ষ করি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের 

গুহা থেকে উলঙ্গ বেরিয়ে এসে নির্মম থেকে গেছো, মগজের বীজস্রোতে

জোয়ার এসেছে, সে চাঁদের ডাকে নয়, হাড়ভাঙা উন্মাদ বিশ্বাসের তর্কে

মূলে অবিশ্বাস, ওদের অপর করে দাও, চাকরি-জমি-টাকাকড়ি কেড়ে নাও--

জ্বালাও খেত-খামার ঘরছাড়া করো নারীদের পাইকারি ধর্ষণ করো--

এদেশে বিদেশে বা দেশহীনতায় আচমকা একদিন একক লোকেরা

হিংস্র হয়ে পথে নেমে পড়ে, অথচ কাউকে চিনি না আমরা, শুধু জানি 

‘ওরা’ ও ‘আমরার’ তফাত : হিংস্রতাই একমাত্র মানবিক আন্দোলন আজ

আইনবিহীনতা অসাম্য ভ্রষ্টাতিভ্রষ্ট ও চতুর্দিকে কালো অবসাদ

তাহলে কি মগজের বীজগুলো ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার, লুটতরাজ ও দাঙ্গার

খুনোখুনি থেকে আনন্দের তালে নৃত্যে মজে ? নাহ, হে, ভিড় বিভাজন

আগাম কল্পনায়, নিজেদের উন্মাদ করে তোলে আত্মা-বিসর্জনে, যুক্তিহীনতায়

যেন মানুষের চেয়ে গরুর গুরুত্ব বেশি -- উন্মাদের নেতৃত্ব দেয় অশুভ

অসাধু অসৎ দুষ্ট আর বেপাড়ার ‘ওরা’ সব্বাই মিলে ‘আমরাদের’

জনতাকে  ধ্বংসের হাতিয়ার করে উদাসীনতার সুবর্ণসুযোগ খুঁজে পায়।

.

বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল ।

সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার 

খোঁপা বেঁধে নিতে আসে -- কিন্ত কার হাতে ?

আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে -- কিন্তু কার তরে ?

হাত নেই -- কোথাও মানুষ নেই, বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন

আলপনার, পটের ছবিত মতো সুহাস্য, পটলচেরা চোখের মানুষী

হতে পেরেছিলো পপায় ; নিভে গেছে সব ।


দুই

ব্যক্তি-একক পচে ধ্বংসযন্ত্র : জ্বলিয়ে দে পুড়িয়ে দে মেরে ফেল বাঞ্চোৎদের--

‘আমরাদের’ চেনে না ‘ওরারা’ অথচ মশাল-রামদা-লাঠি মুখ ঢেকে মগজের

রক্তবীজ নেতাকে জিন্দাবাদ ধ্বনি দেয় ; ‘ওরারা’ অপর তবু বোকা নয়

‘আমরারাও’ মুর্খ নয় -- প্রভাবের বেজন্মা অ্যাণ্ডাবাচ্চার দল, সামাজিক

সনাক্তকরণের সীমা দিয়ে ঘেরা কারাগারে ফালতু তত্বের জেল খাটে---

‘আমি’ বা ‘তুমি’ লোকটা তত্বের অর্বাচিন নিশিডাকে কলহের কৌম-পূর্বপক্ষ

সংক্রামক আচরণে প্রতীক বলতে বৈধ লক্ষ্য ‘কী’/ ‘কারা’ দাঙ্গার লোকেরা 

তাদের ধরে নেওয়া সামাজিক পরিচয় অনুসারে ঘুলঘুলি থেকে বের হয়-- 

নির্বোধের মতো আচরণ করেনাতো, যেন অযৌক্তিক "গোষ্ঠী মন" তাদের মালিক।

তবে কেন ব্যক্তিগতভাবে হিংস্র হয় আর অন্যদের "সংক্রামিত" করে, 

দাঙ্গা করার জন্য প্ররোচিত করে? আচরণ "সংক্রামক" বিষাক্ত প্রক্রিয়া 

কেন তা ছড়িয়ে পড়ে, একজন লোক থেকে অন্য লোক স্বয়ংক্রিয় প্রেরণায় ভোগে ?

সর্বত্র ছড়ায় না কেন ? গ্যাংগ্রিন ও ক্যানসারের ছাঁট আলাদা বলে ?

.

ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হতো

ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি-বাগদির

ঈশ্বরী মেয়ের সাথে

বিবাহের কিছু আগে -- বিবাহের কিছু পরে-- সন্তানের জন্মাবার আগে ।

সেসব সন্তান আজ এ যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়

ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা পড়ে

মৃতপ্রায় ; আজকের এইসব গ্রাম্য সন্ততির

প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে -- অন্ধকারে জমিদারদের

চিরস্হায়ী ব্যবস্হাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে ।


তিন

মসজিদ ভেঙে মন্দির উঠে যায় কোথাও গির্জার রঙ পালটিয়ে মসজিদ

অজস্র ছুটকো-ছাটকা মন্দির ভেঙে কোনও কালে সম্রাটের বোকাটে আদেশে

জিজিয়া আক্রান্ত কেন সোভিয়েত রাষ্ট্র গুবলেট হতেই জেগে উঠলো

অজস্র ঘুমন্ত গির্জা ! হলোকস্টে মরেও মরেনি যারা বদলা নেবার কথা

ভুলতে পারেনি ; কারা যে ফ্যাসিবাদি কারা কমিউনিস্ট স্তালিন নিজেই

জানতো  খুনোখুনি, গুলাগ আর্কিপেলাগোর নিষ্ঠুর র্বরতা, লাশ লোপাট, 

লেখালিখির বিরোধিতা, কবিদের গুমখুন, সোনায়-মোড়া পায়খানাসঙ্গীত

একই বাজনায় বেজেছিল মরিচঝাঁপিতে নানুরে কোথায় অর্চনা গুহ ?

কৃষক তাদের বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে যে জমি চাষ করতেন

তাঁরা যখন জমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো তখন তাদের জন্যে সরকারের 

প্রতিশ্রুতি তাদের নির্বাচন ইস্তেহারের আস্তাকুডেই রয়ে গেলো। আর বিরোধী 

শক্তিরাই ‘ঝামেলা, পথের কাঁটা, শ্রেণি শত্রু, অগণতান্ত্রিক, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা 

সৃষ্টিকারী, উন্নয়নবিরোধী৷’ অতএব, দাওয়াই মুগুর৷ চিনের উইঘুর, 

তিব্বতের বৌদ্ধদের ধর্মস্বাধীনতা চলবে না সকলকে পিটিয়ে এক করো !

জানতে চান কাকে অশ্লীলতা বলা হয় ? হবসের ডিসটোপিয়া নাকি?

.

আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু

হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর

কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে

বধ করে ঘুমাতেছি-- তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে

মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী

সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে

তবুও কোথাও কোনো আলো নেই বলে ঘুমাতেছে ।


চার 

আমি তো দেখেছি নিজের চোখে ভুগেছি বোমা-বেয়নেটে

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে : আর্মেনীয় গণহত্যা, হিরোশিমা ও নাগাসাকি গণহত্যা,

'দ্য হলোকাস্ট', 'গ্রিক গণহত্যা', চীনের গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং 

সাংস্কৃতিক বিপ্লব, কম্বোডিয়ার কিলিং ফিল্ডস, 'সারবিয়ান গণহত্যা', 

'হোলোডোমার গণহত্যা', 'ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যা' রুয়াণ্ডা গণহত্যা

আমি ছিলুম আমি ছিলুম আমি ছিলুম আমি ছিলুম আমি ছিলুম

 '১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গণহত্যা’ এড়াতে যারা এপারে আসছিল

একই ধর্মের ভিনভাষী খুনে-ধর্ষক পয়দল সেনাদের কাড়াকাড়ি থেকে

তারা তো বখতিয়ারের ঘোড়া চেপে যায়নি নোয়াখালী-নাচোলে তবু

স্যার মুখ বড়ো করে জানতে চাইছেন কাকে অশ্লীলতা বলা হয় !

আফগানিসতানে ঢুকে গেল রুশ সেনা কচি-কচি মেয়েদের লোভে

তৈমুর বিন তারাগাই বারলাসের সেনারা যা করেছিল চোদ্দ শতকে

চিরকাল শাসকরা নির্মমতা, বিভাজন, ভয় আর হিংসা ভরা রাষ্ট্র চায়

সে রাষ্ট্রের ধর্ম থাক বা না থাক আস্তিক হোক কিংবা নাস্তিক রাজনেতা

চাকুত্রিশুল নামধাম গুজরাতের ইদি আমিন দাদা পিনোশে লিবিয়ায় !

এখনও জানতে চাইছো কাকে অশ্লীলতা বলে ছাপ্পা মারা হয় ?

.

সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় -- দ্বেষ ।

সৃষ্টির মনের কথা : আমাদেরি আন্তরিকতাতে

আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা

খুঁজে আনা । প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল

ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে

দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল

হয়ে আছে বলে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়


পাঁচ

বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল যারা

তারা তো ভাবেনি সেই বোমা রোহিঙ্গিয়াদের উৎখাত করে দেবে

ছেলেপুলে বউ দাদু  সব্বাই মাথা গুঁজতে পালাবে যেখানে পারে

রাষ্ট্রের কর্ণধার শান্তির নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভুলে গিয়ে

বলবে কই জানি না তো দেখিনি তো অত্যাচারে মরছে লোকেরা

শান্তির নোবেল নিক্সনের চামচা কিসিঞ্জারও পেয়েছিল--

ভিয়েৎনামের সেই উলঙ্গ কিশোরী ফোটোয় পুড়ছে নাপাম-আগুনে

পলপটের সরকারি  জাদুঘরে ৩০০০০০ খুলি আজো চেয়ে আছে

গণপিটুনিতে কারণের প্রয়োজন নেই, ‘ওরা’ মারছে ‘আমরাদের’

তাই ‘আমরারা’ মারব ‘ওরাদের’ ! ‘আমি’-র অপর চাই চাই

রাষ্ট্র যখন ‘আমি’, তাকেও ‘অপর’ খুঁজে বের করা চাই চাই চাই !

তবু লোকে বারবার জিগ্যেস করে কাকে অশ্লীলতা বলা হয় !

.

এ-যুগে কোথাও কোনো আলো -- কোনো কান্তিময় আলো

চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের, নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার

রাত্রির মায়ের মতো ; মানুষের বিহ্বল দেহের

সব দোষ পপক্ষালিত করে দেয় -- মানুষের বিহ্বল আত্মাকে

লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল করে

তাকে আর শুধায় না -- অতীতের শুধানো প্রশ্নের

উত্তর চায় না আর -- শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন

অন্ধকারে ঘিরে রাখে


ছয়

গর্তের ভেতরের ঘর থেকে সাদ্দাম হুসেন উঠে এলো, কিন্তু হাড়গোড়

পাওয়া গেল গড়বেতায় গদ্দাফিকে নর্দমা থেকে টেনে মারা হলো

তবুও তো নৌকোডুবিতে মরছে লিবিয়ার খোকা-খুকু-বউ

রাষ্ট্রের ভাবনায়  বুড়ো কবি ভারভারা রাও উৎখাত করে দেবে তাকে

ইন্দোনেশিয়ার সোয়েকর্ণ সেই কথা ভেবে লক্ষ মানুষ মেরেছিল

একই ভয়ে সালভাদর আয়েন্দের মাথা উড়িয়ে দিয়েছিল নৃশংস সেনা

আনাসতাসিয়ো সমোজা দিবায়ল, জেনারেল পোরফিরিও ডিয়াজ,

অগুস্তো পিনোশে, ম্যানুয়েল নরিয়েগা, ঘন ঘন দেখা দেয় অত্যাচারী 

নৃশংস সব শাসকের দল জেনারেল ইয়াকুবু গোওন ১১ লক্ষ খুনের 

দাগ রয়েছে এই রাষ্ট্রকর্তার হাতে, আর নতুন ভারতের ধাবক হয়েছে

গণসংহার,  জানি না চে গোয়েভারার কাটা হাত দুটো কিউবা থেকে

কোথায় উধাও হলো, বিপ্লবীর কাটা হাতও একদিন প্রাণ পায়

যতো নৃশংস রাষ্ট্র বুঝতে হবে ততো ভিতু তার কুর্সিনশীনেরা--

অথচ রাষ্ট্র আর বিদ্যায়তনিক ছুঁচো জানতে চায় কাকে বলে অশ্লীলতা !

.

তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে

অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে

যে অবনমনে চলেছে আজো -- তার হৃদয়ের

ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার

বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে বলে মনে হয় ।

এসো জ্ঞান, দীনতা, নির্মেঘ দৃষ্টি, শান্তি, আলো, প্রেম ।

……………………………………………………………………

ইটালিক্সে পঙক্তিগুলো জীবনানন্দের কবিতা ‘১৯৪৬-৪৭’ থেকে নিয়েছি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন